সেরা কে? স্বর্ণযুগের ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা?

সান্তানার সাম্বা কিংবা স্ট্যাবিলের পঞ্চপাণ্ডব

ফুটবল
স্ট্যাবিলের পঞ্চপাণ্ডব ও টেলে সান্তানা  © ফাইল ছবি

ঘরের মাঠে ব্রাজিল ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ হেরে যায় উরুগুয়ের কাছে। পুরো ব্রাজিল জুড়ে শোকের ছায়া। এরই মধ্যে একজন এই শোকের স্রোতেই নৌকা নিয়ে ধরতে গেলেন মাছ আর যাবার সময় বললেন এসব খেলার জন্যে কাঁদার কোনো মানেই হয় না।অন্যদিকে আরেকজন শোকে কাঁতর বাবাকে সান্ত্বনা দিলেন যে সে একদিন ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ এনে দিবে। এবং সে বাবাকে দেয়া কথা রেখেছেন,বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন। এই বিশ্বকাপ জয়ের আসরে তাঁর সঙ্গী ছিলেন আবার নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া সেই ছেলেও। এই দুজন মিলে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ দিয়েছে মোট তিনটি। মাছ ধরাকে সেদিন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন গারিঞ্চা, ফুটবলকে সেদিনও গুরুত্বের সাথে নেয়নি, গুরুত্ব দেয়নি ব্রাজিলকে যখন বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন সেদিনও। বাবাকে দেয়া কথা রাখার পাশাপাশি পেলের বিশ্বকাপ জয় তিনবার। এরা আমার আজকের গল্পের নায়ক নয়,পাশ্বচরিত্রও নয়, কিন্তু গল্পের স্বার্থে এদের গুরুত্ব আবার অনেক। 

ব্রাজিলের ১৯৭০ বিশ্বকাপ জয়ী দলকে অনেকেই সর্বকালের সেরা দল বলে থাকেন। আর বলবেই না কেন। শৈল্পিক ফুটবলের পসরা সাজিয়ে ফুটবল তো তাঁরাই খেলেছিল। “জোগো বনিতা” এর সাধারণ বাংলা অর্থ হচ্ছে সুন্দর খেলা। পর্তুগিজ এই শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয় ফুটবলের জন্যে, বিশেষ করে ব্রাজিলকে ঘিরেই যার সব ভাবার্থ।কিন্তু হঠাৎ করেই সব বদলে গেল। ব্রাজিলিয়ানরা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল নিজেদের খেলাতেই। ইউরোপের পাওয়ার-ফিজিক্যাল ফুটবলে মন দিল।১৯৭৪ আর ১৯৭৮ বিশ্বকাপে এল না কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। ফুটবল বিশ্বে ব্রাজিল এমন দল যাদের বিশ্বকাপে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল মানেই বিশ্বকাপ জয়। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিল দলের ডাগআউটে আসলেন টেলি সান্তানা নামের এক ভদ্রলোক।প্রথম যখন টেলি সান্তানার নাম শুনি ভেবেছিলাম এই লোক হয়ত কোনোভাবে মেক্সিকান গিটারিস্ট কার্লোস সান্তানার আত্মীয় হবেন। না দুই সান্তানার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। টেলি সান্তানা ব্রাজিল দলের দায়িত্ব পান ১৯৮০ সালে।টেলি সান্তানা বিশ্বাস করতেন ফুটবল খেলাটা আনন্দের। বিশ্বাস করতেন সাম্বার ছন্দে, জোগো বনিতার অর্থে।

১৯৭৮ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ তুলে মেনোত্তির আর্জেন্টিনা। সে বিশ্বকাপে না থাকলেও নিজেকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে বেশিদিন সময় নেননি ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার ম্যরাডোনাতে সবাই মুগ্ধ,ব্যস্ত।এদিকে ব্রাজিল ব্যস্ত ৮২ বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে। ৭৮ বিশ্বকাপে থাকলেও নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি ততদিনে ব্রাজিলে সবার কাছে “সাদা পেলে” নামে পরিচিতি পাওয়া জিকো।আসলে জিকো নিজের সেরাটা দিতে পারেনি আগের ব্রাজিল দলে।ইউরোপিয়ান টাচে নিজেকেই হারিয়ে বসেছিল জিকো। এবার সান্তানার দলে কেমন খেলে সেটা দেখার জন্যে মুখিয়ে আছে ব্রাজিলিয়ানরা। অবশ্য শুরুতে সান্তানা এবং তাঁর দলকে খেতে হয়েছে অগণিত গালি। কিন্তু সান্তানা বেশ ত্যাড়া মানুষ। নিজের বাইরের মতকে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি কখনোই।

বাছাইপর্বটা আরামসে পার করে সান্তানার দল। প্রথম চারম্যাচে ১১ গোল করে আর খায় মাত্র একটি। বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি আর স্পেনের বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচেও সবার নজর কাড়ে ব্রাজিল দল। ফলে গণমাধ্যমে ব্রাজিল দল নিয়ে শুরু হয়ে যায় বেশ আলোচনা। ফেভারিটের তকমা গাঁয়ে চড়ানোও শুরু হয়ে যায়। অনেকের মতে এই দলটা পেলের ব্রাজিলের পরে সবচেয়ে সেরা দল। ব্রাজিল স্কোয়াডে ছিলেন ১৯৭৪ বিশ্বকাপ খেলা গোলকিপার পেরেস আর মিডফিল্ডার দিরসিউ। ৭৮ এ খেলা জিকো, সেজেরো আর অস্কার। ২৯ বছর বয়সী জিকোর জন্যে এই বিশ্বকাপটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বকে এখনো নিজের জাত চেনানো যে এখনো বাকি। ৭৯ এবং ৮০ সালের দক্ষিণ আমেরিকার সেরা প্লেয়ার ম্যারাডোনাকে পিছনে ফেলে ৮১ সালের পুরস্কার নিজের ঘরে তোলা জিকোও মুখিয়ে আছেন ভালো কিছুর। যদিও এই দলের অধিনায়ক কিংবা মূল নায়ক জিকো বা ফ্যালকাও কেউ না। এই দায়িত্ব এসে পড়ে লম্বা, শুকনো গড়নের সক্রেটিসের উপরে ।সক্রেটিস প্রচুর সিগারেট ফুঁকতেন, খেতেন মদও, দেখতে মোটেও ফুটবলারসুলভ ছিলেন না কিন্তু তাঁর উপস্থিতি দলের জন্যে ছিল অবিচ্ছেদ্য, তাঁর স্পর্শে মুহূর্তেই বদলে যেত দল। জিকো-সক্রেটিস অংশ ছিলেন একটি বিখ্যাত মিডফিল্ড চতুষ্টয়ের। বাকি দুজন ছিলেন রোমার ফ্যালকাও আর অ্যাটলেটিকো মিনেইরোর সেজেরো। ফ্যালকাও ছিলেন ডীপ লাইয়িং মিডফিল্ডার, লংরেঞ্জ থেকে করতেন দুর্দান্ত সব গোল আর সেজেরোর দায়িত্ব ছিল রক্ষণের সাথে মাঝমাঠের সমন্বয়ের। মানুষজন এই দলটাকে ভালবাসত কারণ এরা তাঁদের আগের ছান্দসিক-নান্দনিক ব্রাজিল দলের কথা মনে করিয়ে দিত।

ব্রাজিলের বিশ্বকাপ শুরু হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে গোল খেয়ে। গোলকিপার পেরেসের ভুলে গোল করে লেনিন-স্টালিনের দেশ। দুর্দান্ত একগোলে ব্রাজিলকে সমতায় ফেরানোর পাশাপাশি উজ্জীবিত করার কাজটি করেন অধিনায়ক সক্রেটিস। এদারের বাকী গোলে ম্যাচ সান্তানার দলের। চমৎকার সব গোল হয়ে উঠেছিল এই ব্রাজিল দলের বৈশিষ্ট। ফিনিশিং দারুণ না হলে দেখা যেত গোলগুলো তৈরি হয়েছে ভীষণ সুন্দরভাবে। দ্বিতীয় ম্যাচেও গোল আগে খেয়ে বসে ব্রাজিল কিন্তু স্কটল্যান্ডকে টের পেতে হয় সান্তানার ব্রাজিল দলের ঝালের। জিকো,এদার আর ফ্যালকাও এর গোলে জয় ব্রাজিলের।নিউজিল্যান্ডের জালে এক হালি গোল দিয়ে গ্রুপপর্ব শেষ করে ব্রাজিল। এই ম্যাচের নায়ক একাই জিকো। পরবর্তী রাউন্ডে ব্রাজিলের গ্রুপসঙ্গী ফকল্যান্ড আর ম্যারাডোনা নিয়ে ব্যস্ত আর্জেন্টিনা আর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্রুপপর্ব পাশ করা ইতালি। ব্রাজিল নিশ্চিত ফেভারিট। আসলে সবাই ভেবেছিল ব্রাজিল কয় গোল দেয় প্রতিপক্ষকে সেটি। আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারায় ইতালি। আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের কাছে হারে ১-৩ গোলে এবং বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। ব্রাজিল ইতালির বিপক্ষে ড্র করলেই সেমিতে। ব্রাজিল-ইতালি ম্যাচে শুরুতে এগিয়ে যায় ইতালি, পাওলো রসির গোল। বিশ্বকাপে আগেই দুইবছর ফুটবল থেকে দূরে ছিলেন এই রসি,যাকে দলে নেয়াতে কোচ এঞ্জো বিয়ারজোতকে শুনতে হয়েছে বেশ সমালোচনা। সক্রেটিসের গোলে সমতায় ব্রাজিল। তবে ব্রাজিলের জালে আবার বল জড়ান রসি। এবার ফ্যালকাও এর দারুণ এক গোল ২-২ করে ম্যাচের রেজাল্ট। তখনো ব্রাজিল নিশ্চিত ফেভারিট এবং ম্যাচ যেহেতু ড্র হচ্ছে ব্রাজিল চলে যাচ্ছে সেমিতে। ম্যাচের ১৫ মিনিট বাকি থাকতে মার্কো তারদেল্লির পাসে ইতালিকে আবারো এগিয়ে দেন হ্যাট্রিক পূর্ণ করা পাওলো রসি। ব্রাজিল দল এরপরে একের পর এক আক্রমণ করে গেছে। বিভিন্ন স্টাইলে চেষ্টা চালিয়েও ভাঙতে পারেনি ইতালির রক্ষণ।জিকোকে পুরো বোতলবন্দী করে রেখেছি ইতালি সেদিন। সাদাপেলে আবারো ব্যর্থ।

৫ জুলাই, ১৯৮২; সময় সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিট। স্টেডিয়ামে কিছু মানুষ কাঁদছে, কাঁদছে বললে ভুল হবে, বিলাপ করছে। কেউ কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ বুঝার চেষ্টা করছে কী হল একটু আগে! শুধু স্টেডিয়াম নয়, বলতে গেলে পুরো বিশ্বের অবস্থা এমন। একমাত্র ইতালিতেই মানুষ হাসছে। কিন্তু কেন এমন অবস্থা সবার, বিশ্বের? ইতালির কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ল ব্রাজিল। এই ব্রাজিলিয়ান দলটা কোনো সাদামাটা অর্ডিনারি দল নয়। এই ব্রাজিল দলের খেলা সবার মনপ্রাণ জুড়ে আছে। তাঁদের জেনারেশনের সবচেয়ে সেরা দল। ১৯৫৪ সালের হাঙ্গেরি আর ১৯৭৪ সালের হল্যান্ডকে মিলিয়ে যারা হয়েছেন “আনহলি ট্রিনিটি” মানে সেরা দল হয়েও বিশ্বকাপ জেতা হলো না।

ম্যাচশেষে প্রেস ব্রেফিং এ আসলেন কোচ টেলি সান্তানা। সেখানে উপস্থিত ছিল ৩০০ এর মতন সাংবাদিক-মিডিয়া কর্মী।সান্তানাকে দেখেই সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন।সম্মান জানালেন সান্তানার ব্রাজিল দলকেও। যারা বিশ্বকে নতুন করে ব্রাজিলের সাম্বার ছন্দ-তালের সাথে পরিচিত করে দিয়েছিল। প্রেস ব্রেফিং এ আসার আগে ড্রেসিংরুমে সান্তানা তাঁর প্লেয়ারদের বলেছিল পুরো দুনিয়া তোমাদের তালে নেচেছে, তোমরা সবাই হিরো।সক্রেটিস-জিকো-ফ্যালকাওরা একসাথে খেলেছে পাঁচম্যাচ আর গোল করেছে মোট ১৫টি। আসলে গোলের সংখ্যা কিংবা কীভাবে গোল হয়েছে সেটি আসল কথা নয়। ব্যাপারটা ছিল এই দলের ফিলোসোফির, কল্পনা, শৈলী, লাবণ্য, প্রবৃত্তি এবং খেলার প্রতি ভালোবাসার।

চল্লিশ দশকের বিখ্যাত গ্যাংস্টার ফিল্ম ‘অ্যাঞ্জেলস উইথ ডার্টি ফেইসেস’ এর কথা মনে আছে কারো? মাইকেল কার্টিজের পরিচালনায় জেমস ক্যাগনি, প্যাট’ও ব্রায়ান আর হ্যাম্প্রি বোগার্টের সে কি দুর্দান্ত অভিনয়। মব বসের চরিত্রে অভিনয় করা ক্যাগনিকে আইডল মানতেন সদ্য কৈশোরে পা দেয়া বিম, ক্র্যাব, হাঙ্কি, প্যাটসি, সুইং আর ওদের লিডার সোপি। ক্যাগনির স্পর্শে বাস্কেটবল ছেড়ে ক্যাসিনো আর জুয়ায় মন তাদের। রকি সালিভান মানে জেমস ক্যাগনির কৈশোরটাও কেটেছে এমনি ভাবেই। রকি সালিভান না চাইলেও ওই ছয়জনের দল ওকে গুরু মানা শুরু করে। রকি সালিভান আর তার বন্ধু জেরি কনোলির গল্পে শুরু হওয়া অ্যাঞ্জেলস উইথ ডার্টি ফেইসেস খুবই অনবদ্য ছবি। আমার মতন মার্টিন স্কোরসিজি ভক্তের কাছে তো দারুণ লেগেছে।

“Based in the harbor of the city where lumpenproletariat, Petty criminals and prostitute mingle”. কমিনিজমে এমন একটা বাক্য প্রায়ই বলা হয়।দরিদ্রতাকে এড়াতে মানুষ ছুটে যায় দূরদূরান্তে। তেমনই অনেক স্প্যানিশ আর ইতালিয়ান নাগরিক নতুন বিশ্বে বলে এসে যায় আর্জেন্টিনায়। আর্জেন্টিনার জাতীয় কিংবা ঘরোয়া ফুটবলে তাঁদের উত্তরাধিকারদের ব্যাপক আনাগোনা। যাদের নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি তারাও এর বাইরে নয়। ওজমার কর্বোতা, হামবার্তো ম্যাসিউ, ওমর সিভোরি, অ্যান্তোনিও অ্যাঞ্জেলিলো আর ওসভালদো ক্রুজ এই পাঁচজন হচ্ছে আজকের নায়ক। প্রথম চারজন ইতালিয়ান শিকড়ে আটকা আর শেষজন স্প্যানিশ। একই সাথে এনারা পরিচিত ‘Angels with dirty faces’ নামে। শুরুতেই বলা জেমস ক্যাগনির ছবির নামানুসারেই এনাদের নামকরণ। বাংলাদেশে জন্ম হলে যেমন ধান কাঁটার পরে জমিতে কিংবা ইট পাথরের শহরের ভীড়ে রাস্তায় খেলত ঠিক আর্জেন্টিনার পরতেরোতে খেলেই এদের আগমন। চাইলেই এনাদের পরতেরোর ছেলে বলেও ডাকা যায়।

এই পঞ্চপান্ডবের তান্ডবে ১৯৫৭ সালের কোপা আমেরিকা আর্জেন্টিনা জিতে একেবারে রাজকীয় স্টাইলে। রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে খেলা টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা শিরোপা ঘরে তুলে এক ম্যাচ হাতে রেখেই। পাঁচম্যাচে গোল করে ২৪টি। এই ২৪টি গোলই এসছে এই অ্যাঞ্জেলস উইথ ডার্টি ফেইসেস পাঁচজনের পা থেকে। হামবার্তো ম্যাসিউ ৯টি, অ্যান্তোনিও অ্যাঞ্জেলিলো ৮টির সাথে ওমর সিভোরির ৩ আর ওজমার কর্বোতা ও ওসভালদো ক্রুজের ২টি করে। নিয়ম রক্ষার শেষ ম্যাচে পেরুর কাছে ১-২ গোলে হেরে যায় তারা। প্রথম বিশ্বকাপের নায়ক গুইলের্মো স্ট্যাবিলের অধীণের আর্জেন্টিনা পায় ১১তম কোপা আমেরিকা। এই তো গেলো আক্রমণের কথা। পুরা টুর্নামেন্ট জুড়ে মাত্র ছয়টি গোল খায় আলবিসিলেস্তেরা। যার কারণ রিভারের দ্যা ম্যাকিনার অংশ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নেস্টার পিপো রসি। মাঝমাঠে কিংবা নিজেদের রক্ষণ সীমানায় দাড়িয়েই রসি নির্ধারণ করে দিতেন ম্যাচ কীভাবে চলবে। এতটাই অসাধারণ ছিলেন তিনি।

কলম্বিয়ার জালে ৮ গোল দিয়ে শুরু হয় আর্জেন্টিনার কোপা মিশন। ইনসাইড ফরওয়ার্ড ম্যাসিউ একাই করেন চার গোল।ইতালির বিভিন্ন  ক্লাবের হয়ে দর্শকদের মন ভরিয়ে আর্জেন্টিনার রেসিং এ ক্যারিয়ার শেষ করেন তিনি। ইতালির নীল জার্সিও গায়ে জড়িয়েছিলেন। ইকুয়েডরকে ৩-০ আর উরুগুয়েকে ৪-০ গোলে হারিয়ে টানা তিন ম্যাচ জিতে আকাশি-নীলরা। এবার নায়ক অ্যান্তোনিও অ্যাঞ্জেলিলো। এই প্লেয়ার নিয়ে একটু আলাদাভাবে বলতে হচ্ছে। স্ট্রাইকার হওয়া স্বত্ত্বেও নিজের ডিফেন্সিভ ওয়ার্করেটের জন্যে বিশেষভাবে সুপরিচিত ছিলেন। খেলতে পারতেন এমনকি নাম্বার টেন পজিশনেও।আর গোল স্কোরিং অ্যাবিলিটির কথা বলে লাভ নাই। নিজের জাত চিনিয়ে ইন্টারের হয়ে ষাটের দশকে করেছিলেন ৬৮ গোল। আশ্চার্যের বিষয় হলেও সত্য যে এই তাণ্ডবলীলা যখন চলছে তখন একমাত্র ওসভালদো ক্রুজ (২৬) বাদে কারো বয়স চব্বিশও হয়নি। ম্যাসিউর ছিল ২৩, সিভোরির ২২, কর্বোতার ২১ আর অ্যাঞ্জেলিলোর ১৯। চিলির জালে ৬ আর কিংবদন্তি দুই ফুলব্যাক নিল্টন আর ডিজালমা সান্তোস সাথে দিদি আর এখনো দুনিয়ার কাছে অপরিচিত গারিঞ্চার ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয় আর্জেন্টিনা।

পাঁচ এঞ্জেলের মধ্যে বাকী রইল দুজন। ওমর সিভোরি আর ওজমার কর্বোতা।দুজনকে আলাদা করে নিয়েছি। কীভাবে শুরু করি!যে জুভেন্টাসকে আজকে আমরা দেখছি সে জুভেন্টাস একসময় নিজেদের শহরের সেরা ক্লাবও ছিল না। ভেলেন্তিনো মাজ্জোলার যাদুতে তুরিনো তুরিন শহর তো বটে ইতালির সেরা ক্লাব ছিল। জন চার্লস আর জিয়াম্পিয়রি বোনাপার্তেকে সাথে নিয়ে সিভোরি জুভেন্টাসের রূপ বদলে দেয়। তখনকার সময়ে রেকর্ড ৯১ হাজার পাউন্ডে জুভেন্টাসে তাঁকে নিয়ে আসে জিয়ান্নি অ্যাগ্নেল্লি। এল ক্যাবাজোন মানে বড়ো মাথার সিভোরি ফুটবলে যেমন ব্রিলিয়ান্ট ছিল তেমনি নাছোড়বান্দাও বেশ। বিপক্ষ দলের প্লেয়ারদের অপমান করতে ভালোবাসতেন, তবে সেটি ফুটবলেই। একই প্লেয়ারকে পরপর দুবার ড্রিবল করতেন শুধু সবাইকে দেখাতে যে আমার লেভেলই আলাদা। জন চার্লস খেলার মাঝে সিভোরিকে চড় মারতেন যাতে শুধু সে শান্ত হয়,মেজাজ হারিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু না করে বসে। নাটমেগ,ফেইন্টস,স্টেপ-ওভার, স্পিড সিভোরির কম ছিল না কিছুই। জুভেন্টাসের প্রথম প্লেয়ার হিশেবে ১৯৬১ সালে ব্যালন ডি-অর জিতেন তিনি। যে অ্যাঞ্জেলসদের নিয়ে কথা বলেছি তাঁদের মধ্যে সেরা অবশ্যই বাঁ পায়ের সিভোরি। জুভেন্টাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিলেন সিভোরি।

“Creative playing style, left footed skill, eye for goal, country of birth, hairstyle, strong mentality, at times rebellious nature both on and off the field and left footed”. কার সাথে যেন মিলে যাচ্ছে সব।হুম ডিয়েগো ম্যারাডোনা।ম্যারাডোনাকে দেখে অনেকেই সিভোরিকে ষাটের ম্যারাডোনা বলত। অনেকের কাছেই আবার ব্যাপারটা উল্টো। ম্যারাডোনা-মেসিদের আসল পথিকৃৎ ওমর সিভোরিই।

এবার আসি আর্জেন্টাইন গারিঞ্চাকে নিয়ে কিছু বলার।ওজমার ওরেস্তে কর্বোতা। গারিঞ্চার মতন উইংগার ছিলেন। মদ-নারীর দিক দিয়েও গারিঞ্চার সমতুল্য। কর্বোতার একটি বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা ছিল পেনাল্টিতে গোল করার। জীবনে ৬৪ পেনাল্টি নেয়া কর্বোতা গোল করেছেন ৬১টিতেই। রিভার প্লেটের লিজেন্ডারি গোল কিপার আমাডো কারিজো সুইডেনে ৫৮ বিশ্বকাপ চলার সময় কর্বোতার সাথে বাজী ধরেছিলেন যে কর্বোতার নেয়া ৫০ পেনাল্টির অন্তত ১০টি হলেও তিনি সেইভ করবেন। কর্বোতা গোল করেছিল ৪৯টি। বাকিটা কি ধরতে পেরেছিলেন কারিজো? নাহ, সেটি গোলবারের বাইরে মেরেছিলেন আর্জেন্টাইন গারিঞ্চা। ১৯৫৭ এর কোপায় ব্রাজিলের বিপক্ষে তাঁর পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে গোটা লিমা শহর তাঁর ভক্ত বনে গিয়েছিল। ম্যাচ শেষে তাঁদেরকে নিজের জার্সি উপহার দেন কর্বোতা। মাঝেমধ্যে এতটাই মদে বুঁদ হয়ে থাকতেন যে ভুলে যেতেন ম্যাচের কথা।একবার পুরো মাতাল অবস্থায় খেলতে নেমে গেলেন। সতীর্থদের বললেন তাঁকে পাস না দিতে কারণ তিনি কিছুই ঠিকঠাক দেখছেন। ওই ম্যাচেও জোড়া গোল করেন কর্বোতা। এই ব্যাপারটা পড়ার সময় আমি পুরো তাজ্জব হয়ে গেলাম। ফুটবল ঈশ্বর যেন দুহাত ভরে দিয়েছিলেন এই লোককে। কর্বোতা যখন ড্রিবলিং করে এগিয়ে যেতেন তখন কারো সাধ্য ছিল না তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নেয়ার। একবার এক সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গে কর্বোতা বলেছিল, “Do you know why nobody could take the ball from me, cause she(ball)didn’t want to abandon me. Other things were indeed taken away from me”. ব্রাজিলের গারিঞ্চা আর আর্জেন্টিনার গারিঞ্চার জীবনের শেষের দিকটাও একই। দুজনই মারা যান একলা, নিঃস্ব, সম্বলহীন এবং অসহায়ভাবে।

কোচ স্ট্যাবিল কীভাবে পেলেন এদের সবাইকে একসাথে খেলানোর আইডিয়া। এই টুর্নামেন্টের আগে তিনটি ফেন্ড্রলি ম্যাচে খেলিয়েছিলেন এদের, আসলে কাকে নিবেন সেটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ওই তিন ম্যাচে তারা গোল করেছিল ১৭টি। দল নির্বাচনে কোচ স্ট্যাবিলকে আর দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। এই “Angels with dirty faces”রা একসাথে এই একটি টুর্ণামেন্টই খেলেছে। একসাথে খেলে মাত্র ছয়টি ম্যাচে তারা যে নৈপুণ্যের সমারোহ করে গেছেন তা আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে ৬৪ বছর পরেও।মাইকেল কার্টিজের ছবির নামানুসারে দর্শক এমনকি দলের স্টাফ ও সতীর্থরাও কর্বোতা,সিভোরি,অ্যাঞ্জেলিলো, ক্রুজ আর ম্যাসিউকে ডাকতেন সেই একই নামে। আরেকটি জিনিশ তারা চলে যাবার পরে আর্জেন্টিনা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, লা নুয়েস্ত্রা মানে আমাদের ধরণ মানে যে ধরনের নান্দনিক-ছান্দসিক-মনমাতানো ফুটবল আর্জেন্টিনা খেলে এসছিল এতদিন। স্পিনেত্তো-জুবেলদিয়া-বিলার্দোদের হাতে আসে অ্যান্টি ফুটবল। যার গল্প হবে অন্য কোনো দিন।


মন্তব্য