দুবাইয়ে ফাঁস হওয়া ধনীদের গোপন সম্পদের তালিকায় ৩৯৪ বাংলাদেশি

দুবাই
  © ফাইল ছবি

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। ট্যুরিস্ট ও বিনিয়োগকারী টানতে বিভিন্নি উদ্যোগ হাতে নেয় দেশটি। এর মধ্যে গগণচুম্বী বিল্ডিং, বিলাসবহুল হোটেলসহ করমুক্ত বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধনকুবেররা দেশটিতে বিনিয়োগ করতে থাকে, ভিড় করতে থাকেন ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা। অর্থের উৎস সম্পর্কিত কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই ব্যাংক কিংবা ব্যক্তিগত বিমান ভরে অর্থ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে আমিরাতে। আর এই সুযোগে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা ব্যক্তি, অর্থপাচারকারী ও অপরাধীরা দুবাইয়ে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

‘দুবাই আনলকড’ নামে বৈশ্বিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক প্রকল্পে দুবাইয়ে গড়ে ওঠা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মানুষের এই সম্পদের গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছে। অনুসন্ধানী এই প্রকল্পে ৫৮টি দেশের ৭৪টি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা দীর্ঘ ছয় মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছেন।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) ও নরওয়ের সংবাদমাধ্যম ই-টোয়েন্টিফোরের নেতৃত্বে এই অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। 

গতকাল মঙ্গলবার (১৪ মে) ‘দুবাই আনলকড’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ওসিসিআরপি।

বিভিন্ন দেশের সন্দেহভাজন অপরাধী, নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা দুবাইয়ে কীভাবে নিরাপদে সম্পদ কিনেছেন, সেই চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্স ডিফেন্স স্টাডিজ (সি৪এডিএস) প্রথম এই ফাঁসকৃত তথ্য পায়। দুবাইয়ের সরকারি ভূমি দপ্তরসহ অন্যান্য রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ফাঁস হওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান চালানো হয়। ওসিসিআরপি বলছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল নাগাদ দুবাইয়ে বিদেশিদের মালিকানায় থাকা সম্পদের পরিমাণ ১৬০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুবাইয়ে বিদেশিদের সম্পদের মালিকানার তালিকায় শীর্ষে আছেন ভারতীয়রা। দেশটির ২৯ হাজার ৭০০ জন নাগরিকের ৩৫ হাজার সম্পত্তি রয়েছে দুবাইয়ে। ২০২২ সাল পর্যন্ত দুবাইয়ে ভারতীয়দের এসব সম্পত্তির মোট মূল্য ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বলে ধারণা করা হয়। ভারতের পর এই তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান। দুবাইয়ে ১৭ হাজার পাকিস্তানির হাতে ২৩ হাজার সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে।

আমিরাতের এই শহরে গোপন সম্পদের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানি থেকে শুরু করে বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানেরও গোপন সম্পদের খোঁজ মিলেছে দুবাইয়ে। দুবাইয়ের কৃত্রিম দ্বীপ পাম জুমেইরাতে মুকেশ আম্বানির প্রায় ২৪ কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে।

আর পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলে হুসাইন নওয়াজ শরিফ, সাবেক স্বৈরশাসক প্রয়াত পারভেজ মুশাররফসহ দেশটির বর্তমান সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীরও নাম রয়েছে এই তালিকায়।

দুবাইয়ে গোপন সম্পদের বিষয়ে ফাঁস হওয়া তথ্যে কয়েকশ’ বাংলাদেশিরও পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। ওসিসিআরপির তথ্য বলছে, আকাশচুম্বী অট্টালিকার এই শহরে গোপনে সম্পদ গড়েছেন অন্তত ৩৯৪ জন বাংলাদেশি। শহরটিতে এই বাংলাদেশিদের মালিকানায় রয়েছে ৬৪১টি সম্পত্তি। বাংলাদেশিদের মালিকানায় থাকা এসব সম্পত্তির মূল্য ২২ কোটি ৫৩ লাখ ডলারেরও বেশি।

তবে বাংলাদেশিদের সম্পদ ও মালিকানার তথ্য জানানো হলেও তাদের বিষয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি ওসিসিআরপি।

ফোর্বসের প্রতিবেদনে ১০ ধনকুবেরের নাম, তাদের নিট সম্পদ ও দুবাইয়ে থাকা সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

মুকেশ আম্বানি
ফোর্বসের প্রতিবেদনের শুরুতেই রয়েছে ভারতীয় নাগরিক মুকেশ আম্বানির নাম। তার নিট সম্পদ ১১ হাজার ২০ কোটি ডলার। সম্পদের উৎস হিসেবে ‘বিভিন্ন খাত’ উল্লেখ করা হয়েছে। দুবাইয়ের পাম জুমেইরাহ কৃত্রিম দ্বীপে তাঁর আনুমানিক ২৪ কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে।

এম এ ইউসুফ আলী
তিনিও ভারতীয় নাগরিক। তার পরিবারের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৭৮০ কোটি ডলার। সম্পদের উৎস ‘বিভিন্ন খাত’। পাম জুমেইরাহ, দুবাই মেরিনা ও ইন্টারন্যাশনাল সিটিতে তাঁদের ৭ কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ রয়েছে।

শামশীর ভায়ালিল
আরেক ভারতীয় শামশীর ভায়ালিলের সম্পদ ৩৫০ কোটি ডলারের। সম্পদের উৎস ‘স্বাস্থ্যসেবা’ খাত। দুবাই হিলস ও দুবাই প্রোডাকশন সিটিতে তিনি ৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সম্পদের মালিক।

সুহাইল বাহওয়ান
তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের নাগরিক। ১৯০ কোটি ডলার সম্পদের মালিক সুহাইল বাহওয়ান। সম্পদের উৎস ‘বিভিন্ন খাত’। জুমেইরাহ বে আইল্যান্ড, মেদান ও ডাউনটাউন দুবাইয়ে তাঁর সাড়ে ৪ কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে।

আন্দ্রেই মোলচানভ
রাশিয়ার নাগরিক আন্দ্রেই মোলচানভ ও তার পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ১৩০ কোটি ডলার। সম্পদের উৎস ‘নির্মাণসামগ্রী’। পাম জুমেইরাহ এলাকায় তাঁদের ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের সম্পদ রয়েছে।

বিনোদ আদানি
তিনি সাইপ্রাসের নাগরিক। ২ হাজার ২২০ কোটি ডলারের সম্পদের মালিক এই বিনোদ আদানি। তার সম্পদের উৎস দেখানো হয়েছে ‘অবকাঠামো ও পণ্যদ্রব্য’। এমিরেটস হিল, জুমেইরাহ লেক টাওয়ারস, জুমেইরাহ পার্ক, ডাউনটাউন দুবাই, দুবাই মেরিনা, ইন্টারন্যাশনাল সিটি ও দুবাই সিলিকন ওয়েসিসে তাঁর ২ কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে। অবশ্য ওসিসিআরপির ওয়েবসাইটে বিনোদ আদানিকে ভারতীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

চ্যাংপেং ঝাও
কানাডার নাগরিক চ্যাংপেং ঝাও ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের সম্পদের মালিক। সম্পদের উৎস ‘ক্রিপ্টো মুদ্রা বিনিময়’। ডাউনটাউন দুবাইয়ে তাঁর ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সম্পদ রয়েছে।

সকেট বর্মন
তিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তার সম্পদের পরিমাণ ১৫০ কোটি ডলার। সম্পদের উৎস ‘ভোগ্যপণ্য’। দুবাইয়ের পাম জুমেইরাহ দ্বীপে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সম্পদ রয়েছে সকেট বর্মনের।

ইগর মাকারভ
সাইপ্রাসের নাগরিক ইগর মাকারভ। তিনি ২১০ কোটি ডলারের সম্পদের মালিক। সম্পদের উৎস ‘বিনিয়োগ’। পাম জুমেইরাহ এলাকায় তিনি ১ কোটি ১০ লাখ ডলারের সম্পদের মালিক।

নগিব সাবিরিস
তিনি মিশরের নাগরিক। নগিব সাবিরিস ও তার পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ৩৮০ কোটি ডলার। সম্পদের উৎস ‘টেলিকম’ খাত। পাম জুমেইরাহ এলাকায় তাঁদের ১ কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে।

আফগান নাগরিকদের নামও আছে তালিকায়
দারিদ্র্যপীড়িত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অন্তত সাত নাগরিকের নামও রয়েছে দুবাইয়ে গোপনে সম্পদ গড়া ব্যক্তিদের তালিকায়। তাদের মধ্যে ছয়জনকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও একজনকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

আছে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পরিবারের সদস্যরাও
পাকিস্তানের পত্রিকা ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী দুবাইয়ে ১৭ হাজার পাকিস্তানি সম্পদের মালিক। তবে তথ্য-উপাত্ত ও অতিরিক্ত সূত্র ব্যবহার করে এ সংখ্যা ২২ হাজারের মতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

ওই তালিকায় নাম রয়েছে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি, বাখতাওয়ার ভুট্টো জারদারি ও আসিফা ভুট্টো জারদারি; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভির স্ত্রী মিসেস আশরাফ; সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলে হুসাইন নওয়াজ এবং আলোচিত সাবেক সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার ছেলে সাদ সিদ্দিক বাজওয়ারের।

তালিকায় আরও যারা আছেন

এছাড়াও তালিকায় চীন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকদের পাশাপাশি ইয়েমেন, নাইজেরিয়া ও কেনিয়ার মতো দেশের নাগরিকদের নামও রয়েছে। রয়েছে নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা মিয়ানমারের একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর নামও।

সূত্র: ফোর্বস, ওসিসিআরপি