বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিনব্যাপী অভিজ্ঞতার ঝুঁলি

বোটানিক্যাল
  © সংগৃহীত

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক উৎস থেকে তৈরি ওষুধের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। এ চাহিদার কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি এবং কেমিক্যালভিত্তিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য। প্রাকৃতিক চিকিৎসা এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা প্রকৃতির উপাদান এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে সহায়তা করে। এটি আধুনিক চিকিৎসার বিকল্প নয়; বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান রোগ নির্ণয় ও দ্রুত নিরাময়ের জন্য কার্যকরী হলেও, অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক চিকিৎসার মাধ্যমে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং দীর্ঘমেয়াদী সুস্থতা অর্জন সম্ভব।

বিশেষ করে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (WHO) প্রাকৃতিক চিকিৎসার গুরুত্ব স্বীকার করেছে এবং বিভিন্ন দেশে ঐতিহ্যবাহী ভেষজ চিকিৎসা গবেষণার ওপর জোর দিচ্ছে। বর্তমানে গ্লোবাল ওষুধ শিল্পেও প্রাকৃতিক উৎস থেকে তৈরি ওষুধের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকান পাইজিয়াম ছাল প্রোস্টেট সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হচ্ছে, আর গুগুল গাছের রজন কোলেস্টেরল কমানোর জন্য কার্যকরী হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও, ওক গাছের ছাল রক্তক্ষরণ কমাতে সাহায্য করে এবং জিনসেং উদ্ভিদ দেহের শক্তি ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। ননি ফল, যা দক্ষিণ এশিয়ায় জনপ্রিয়, তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পেটের সমস্যা সমাধানে উপকারী বলে মনে করা হয়।

প্রাচীনকালে ফার্মাকোগনসি বা ঔষধি গাছ নিয়ে গবেষণা মূলত অভিজ্ঞতাভিত্তিক ছিল। আয়ুর্বেদ, ইউনানি, এবং চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঔষধি গাছের ব্যবহার শুরু হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে। উদাহরণস্বরূপ, কালমেঘ লিভারের রোগ নিরাময়ে, তুলসী শ্বাসকষ্ট ও ঠান্ডা কমাতে, এবং থানকুনি হজমশক্তি বৃদ্ধি ও ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত হত। এই জ্ঞান সাধারণত প্রজন্মের পর প্রজন্ম মৌখিকভাবে সংরক্ষিত ছিল।প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্রেও বিভিন্ন উদ্ভিদের ব্যবহার দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, মিশরীয়রা অ্যালোভেরাকে ত্বকের যত্ন ও ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহার করত, আর গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস উইলো গাছের বাকল থেকে ব্যথানাশক তৈরি করেছিলেন, যা পরবর্তীতে অ্যাসপিরিন তৈরির উৎস হয়েছে। 

এছাড়াও, ভারতীয় গুলঞ্চ বা গিলয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। মশলার রাজা হিসেবে পরিচিত লং শ্বাসকষ্ট ও দাঁতের ব্যথা উপশমে কার্যকরী, যা বহু প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অপরদিকে, আধুনিক ফার্মাকোগনসি বিজ্ঞানের ভিত্তিতে আরও সংগঠিত এবং পরিমাপযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, হলুদের সক্রিয় উপাদান কারকিউমিন প্রদাহপ্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত। আদায় উপস্থিত জিঞ্জারল এবং শোগাওল আর্থ্রাইটিসের প্রদাহ এবং ব্যথা উপশমে ব্যবহৃত হয়।

এছাড়া, পেয়ারা পাতার নির্যাস ডায়রিয়া ও পেটের ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর, আর তুলসী শুধুমাত্র ঠান্ডা-কাশি নয়, বরং মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে। তাছাড়া, গ্রিন টি-তে থাকা ক্যাটেচিন হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে এবং ব্রাহ্মী শাকে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে দারুণ ভাবে সাহায্য করে। যারফলে শরীর থেকে ক্ষতিকর দূষিত পদার্থ বের হয়ে ক্যানসারের সম্ভাবনা কমে যায়। এছাড়াও ব্রাহ্মীতে ব্যাকোসাইড নামে একটি রাসায়নিক থাকে। যা স্নায়ুকোষের অবক্ষয় অনেকটাই বন্ধ করে দেয়। এই শাক মস্কিষ্কের কিছু রাসায়নিকের ক্ষরণ বাড়ায়। ফলে স্মৃতিভ্রম কমে। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, নীলকণ্ঠ ফুলের নির্যাস উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে এবং করল্লার নির্যাস রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমাতে সহায়ক। বাসক উদ্ভিদ শ্বাসকষ্ট এবং ঠান্ডাজনিত সমস্যায় কার্যকর, আর থানকুনি ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ঠান্ডা-কাশি, আর্থ্রাইটিস এবং ত্বকের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এসব উদ্ভিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

অপরদিকে নিউট্রাসিউটিক্যালস হলো খাদ্যজাত পণ্য যা স্বাস্থ্যগত সুবিধা প্রদান করে এবং নির্দিষ্ট রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসায় সহায়ক। এগুলো সাধারণত ভিটামিন, মিনারেল, হার্বাল এক্সট্রাক্ট, প্রোবায়োটিক, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, এবং অন্যান্য কার্যকরী উপাদান ধারণ করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো (যেমন স্কয়ার, বেক্সিমকো, রেনেটা) নিউট্রাসিউটিক্যালস খাতে বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া কিছু দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপ এই খাতে নতুন নতুন পণ্য আনছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিউট্রাসিউটিক্যালসের বাজারও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে, যার ফলে সাপ্লিমেন্ট এবং হার্বাল পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস)-এর ফার্মেসি বিভাগের উদ্যোগে সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন পরিদর্শন করেছেন। ঢাকা শহরের মিরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন দেশের বৃহত্তম উদ্ভিদ সংরক্ষণ কেন্দ্র। এটি প্রায় ৮৪ হেক্টর (২১০ একর) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে স্থানীয় ও বৈশ্বিক গবেষণার জন্য ৫৬০ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ সংরক্ষিত রয়েছে। জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন উদ্ভিদ সংরক্ষণ, গবেষণা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে সংরক্ষিত ঔষধি উদ্ভিদগুলো আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং ফার্মাকোগনসি চর্চার জন্য অমূল্য সম্পদ। 

এছাড়াও, এখানে সংরক্ষিত মিরুবালান ফলের নির্যাস কিডনি ফাংশন উন্নত করতে সহায়ক, আর শ্বেত চন্দনের নির্যাস ত্বকের রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। টেপরঙ্গা উদ্ভিদ, যা সাধারণত কম পরিচিত, এটি স্নায়ু শিথিল করতে এবং ঘুমজনিত সমস্যার চিকিৎসায় কার্যকরী বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন, এক প্রাকৃতিক ওষুধের ভান্ডার, যেখানে প্রতিটি গাছের পাতা, ফুল, এবং শিকড়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে রোগ নিরাময়ের অদ্ভুত ক্ষমতা। বিশেষত, কস্তুরী মেথি শুধুমাত্র ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেই নয়, এটি চুলের বৃদ্ধি বাড়াতেও ব্যবহৃত হয়। 

অপরদিকে, রুদ্রাক্ষ গাছের বীজ মানসিক চাপ কমাতে ও ধ্যানের সময় মনঃসংযোগ বাড়াতে সহায়ক বলে বিশ্বাস করা হয়।এই গার্ডেনের অনন্য উদ্ভিদ সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে মহুয়া, কৃষ্ণচূড়া, শ্বেত চন্দন, আমলকী, বাওবাব ইত্যাদি। এসব উদ্ভিদ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে না বরং ঔষধি গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উৎস।উদ্যানের লতা-গুল্ম ও বৃক্ষের বিশাল সংগ্রহে রয়েছে ২২ প্রজাতির বাঁশ, ১৬ প্রজাতির ইউক্যালিপটাস এবং আকাশমণি। 

এছাড়া বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের বাগানে কালমেঘ, পুনর্নভা, শতমূলী এবং তেলাকুচার মতো উদ্ভিদ স্থান পেয়েছে, যা হজমশক্তি বৃদ্ধি, প্রদাহ নিরাময় এবং লিভারজনিত রোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।উদ্ভিদের এই বৈচিত্র্যময় সংগ্রহের মধ্যে আরও রয়েছে নাগেশ্বর গাছ, যার ফুল থেকে তৈরি তেল আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে ব্যথা উপশমে ব্যবহৃত হয়। মধুকরী গাছের ছাল, যা সাধারণত উপেক্ষিত, এটি বাতজনিত ব্যথা ও ত্বকের প্রদাহ কমাতে সহায়ক।এই কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঔষধি গাছ এবং তাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে বাস্তবজ্ঞান লাভ করেছেন। শিক্ষার্থীরা ঔষধি গাছের বিভিন্ন প্রজাতি, তাদের চাষাবাদ, সংগ্রহ এবং ঔষধি ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করেন।

শিক্ষার্থীরা এই সফরের মাধ্যমে ঔষধি গাছের কার্যকারিতা এবং আধুনিক ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে তাদের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। তারা ঔষধি গাছের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সম্পৃক্ত হতে এবং নতুন ওষুধ উদ্ভাবনে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।বিশ্বজুড়ে হারবাল ওষুধের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, এ ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যৎ গবেষকদের উদ্ভিদ-ভিত্তিক ওষুধের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ এবং নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনে উৎসাহিত করবে। বিশেষ করে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ঔষধি গাছের সংরক্ষণ ও গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উদ্যান পরিদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছে, যা তাদের ভবিষ্যতের গবেষণা এবং পেশাগত দক্ষতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

ইউআইটিএস-এর এই উদ্যোগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি আরও সচেতন করে তুলবে। ভবিষ্যতে, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, প্রাকৃতিক উৎস থেকে ওষুধ প্রস্তুত করার প্রযুক্তি আরও উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। হারবাল চিকিৎসা কেবল ব্যক্তিগত সুস্থতার জন্যই নয়, বরং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

লেখক, মো: তৌফিকুল ইসলাম
প্রভাষক, ফার্মেসি বিভাগ
ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস)