নুর-রেজার

অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে গণ অধিকার পরিষদে ভাঙনের সুর

গণ অধিকার পরিষদ
নুরুল হক নুর ও রেজা কিবরিয়া  © সংগৃৃহীত

নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাত্র দেড় বছরের মাথায় ভাঙনের মুখে গণঅধিকার পরিষদ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া ও সদস্য সচিব নুরুল হক নুরের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তুলে ধরছেন।

এরই মধ্যে সোমবার (১৯ জুন) রাতে দলটির এক জরুরি সভায় রেজা কিবরিয়াকে সরিয়ে গণঅধিকার পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়েছে দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে।

ওইদিন রাতে নুরুল হক নুর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিযোগ করে বলেন, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট পরিচয়ে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় জনৈক মাসুদ করিম/এনায়েত করিমের বিএনপি ভাঙা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উকিল আব্দুস সাত্তার মডেলে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিতে কথিত সরকারবিরোধী প্রোগ্রামের নামে রেজা কিবরিয়া ব্যাংকক, কাঠমান্ডুতে একাধিকবার মিটিংয়ে অংশ নেন। এসব বিষয়ে জবাবদিহি চাওয়া হলে তিনি কোনো সদুত্তর দেননি। রেজা কিবরিয়া কতটুকু অযোগ্য সেটা তার কাজকর্মে ইতোমধ্যে আপনারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। গণঅধিকার পরিষদের মতো একটা সম্ভাবনাময় দলের আহ্বায়ক হয়েও তিনি ওইভাবে দলের মিটিং-মিছিল,কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন না। বরং টাকার লোভে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার ফাঁদে পড়ে তিনি বিএনপি ভেঙে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দুঃস্বপ্নে বিভোর। আমরা সেটাতে সমর্থন না দেওয়ায় আমাকে নিয়ে মিথ্যাচার করে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে গণঅধিকার পরিষদে ভাঙন ও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই আপনারা অবগত আছেন, এই রেজা কিবরিয়ার কারণেই গণফোরাম ভেঙেছিল।

অন্যদিকে গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক পদে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে মন্তব্য করেছেন রেজা কিবরিয়া। বর্তমানে তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। দেশে ফিরে প্রয়োজনে নুরকে দল থেকে বহিষ্কার করবেন বলে জানিয়েছেন দলটির এই আহ্বায়ক।

গণমাধ্যমকে ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, দলের মধ্যে টাকা-পয়সার হিসাব চাওয়া নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। নুর প্রবাসে কমিটি গঠনের ব্যাপারে নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে অনুমোদন দিয়েছেন। অথচ দলের প্রধান হিসেবে আমাকে ওই পদ দেওয়ার কথা। দলীয় ফান্ডের কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই। কাউকে হিসাবনিকাশ দিতে চান না তিনি। আমি দলের প্রধান, কিন্তু আমাকে হিসাবনিকাশ দেন না। এখন আমি হিসাব চাওয়াতে তিনি আজেবাজে কথা বলছেন। দ্বিতীয়ত, ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে তিনি যে বৈঠক করেছেন; এটি কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই।

রেজা কিবরিয়া বলেন, কী কারণে, কেন ওই বৈঠক করলেন এবং বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন কেন? ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? তারা কি দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাবে? নাকি ভিপি নুর টাকা পেয়েছেন? অবশ্য যারা তাকে গাড়িতে করে নিয়ে গেছেন তারা জানিয়েছেন, বৈঠকের পর ‘কালো একটি ব্যাগ’ নিয়ে তিনি গাড়িতে উঠেছেন। টাকা-পয়সা নিয়ে তিনি কী করেছেন? নিজের স্বাক্ষরে কেন করেছেন– জানি না। আবার ভারতসহ বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকের সঙ্গেও গোপন বৈঠক করেন নুর। অথচ দলের আহ্বায়ক হিসেবে আমি তা জানি না। এসব কারণে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ভিপি নুর এখন বড় নেতা হয়ে গেছেন! রাজনীতি বেশি বোঝেন! আমি তার কথায় চলি না– এসব কারণে সংকটের সমাধান হবে না।  আমি আইএমএফের বড় চাকরি ছেড়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি। সারাজীবন হালাল টাকা-পয়সা রোজগার করেছি। এখন আমার দলের মধ্যে কেন আর্থিক অস্বচ্ছতা থাকবে– এটা তো মেনে নিতে পারি না।

জাতীয় ইনসাফ কমিটির কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নিয়ে নুরের অভিযোগের বিষয়ে ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, সরকারবিরোধী যে কোনো দল ও সংগঠনের আন্দোলন কর্মসূচিতে আমি অতীতে ছিলাম এবং ভবিষ্যতেও থাকব। আমি ইনসাফ কমিটির কোনো পদ-পদবিতে নেই। সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত– যে ডাকবে, আমি সেখানে যাব।  

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ভিপি নুর মিথ্যা কথা বলছেন। অর্থ লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এসব ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলছেন। নুরের নেতৃত্বে দলের ছোট একটি অংশ এসব বলতে পারে। দলের বড় অংশ আমার সঙ্গে রয়েছে। দলের অনেক নেতাই দুঃখ প্রকাশ করে বলছেন, দলের মধ্যে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকে, তাহলে কীভাবে আমরা প্রমাণ করব– আওয়ামী লীগের চেয়ে আমাদের দল ভালো কিছু করবে?

ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, আমার বিচার-বিবেচনার সঙ্গে তো নুরের বিচারবোধ এক হতে পারে না। আমার বয়স, অভিজ্ঞতা তার চেয়ে বেশি। তিনি যে লেভেলে বড় হয়েছেন, সেই লেভেলেই চিন্তা করবেন। এটিই স্বাভাবিক। আমি বাংলাদেশে এসেছি দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করার জন্য; রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে। আমি তো নুরের মতো পরিবার থেকে আসিনি। তার কাছ থেকে আমার শেখারও কিছু নেই। তবে এখন আমার অনুমতি ছাড়া কোনো বৈঠক হবে না। আমি চিঠি ইস্যু করেছি। নুর দলকে অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

সবমিলিয়ে গণঅধিকার পরিষদের শীর্ষ দুই নেতার পরস্পরবিরোধী অবস্থান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যে কোনো সময় দলটি ভেঙে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

এর আগে, ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়াকে আহ্বায়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে সদস্য সচিব করে গণ অধিকার অধিকার পরিষদ গঠন করা হয়।