আত্মহত্যা প্রতিরোধে ইসলামের অনুশীলন

আত্মহত্যা
  © প্রতীকী ছবি

২০২২ সালের সারা দেশে ৪৪৬ জন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। গড় হিসাবে যা দাঁড়ায় প্রতি মাসে প্রায় ৪৪.৩৩ জন। সম্প্রতি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তৈরি করা এক সমীক্ষার এমন তথ্য উঠে এসেছে।

আত্মহত্যা কী?

আত্মহত্যা মহাপাপ। শিরকের পর সবচেয়ে বড় গোনাহ। সব ফিকাহবিদ এবং চার মাজহাবেই আত্মহত্যা হারাম। এগুলো আত্মহননকারী ব্যক্তিরও অজানা নয়। তবু হতাশা, অধৈর্য ও পারিবারিক নানা কলহে মানুষ এ পাপের দায় নিয়েও জঘন্য পথটি বেছে নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যার ভয়াবহ পরিসংখ্যান উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের জন্য এটি একটি দুঃখজনক বিষয়।

আত্মহত্যা মানে নিজকে নিজে ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম কষ্ট ও যন্ত্রণা দেওয়া। নিজ হাতে নিজের জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটানো। তুচ্ছ পারিবারিক কলহ, বিদ্যালয়ের গমনাগন পথে বখাটেদের উৎপাত, ভালোবাসায় ব্যর্থতা ও প্রতারণা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তরুণীরা এবং স্বামীর নির্যাতন-অত্যাচার, যৌতুক সমস্যা, স্বামীর অর্থনৈতিক অক্ষমতা, পারিবারিক অশান্তি থেকে বাঁচার পথ হিসেবে অনেক নারী আত্মহত্যাকে বেছে নিচ্ছে। এ সবই ভুল, এসব সমস্যা সব দেশে, সব জাতিতে আছে। আত্মহত্যা এসবের কোনো সুষ্ঠু সমাধান কিংবা সঠিক প্রতিকার নয়।

আত্মহত্যার নিষেধাজ্ঞা কোরআনে

আল্লাহতায়ালা মানুষকে মরণশীল হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। ধনী-গরিব, বিদ্বান-মূর্খ, রাজা-প্রজা সবাইকে মরতে হবে। আর এ মৃত্যু দান করেন একমাত্র আল্লাহ। তিনি ছাড়া কেউ কাউকে মৃত্যু দিতে পারে না। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান আর তার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে।’ -সুরা ইউনুস : ৫৬

বর্ণিত আয়াতের স্পষ্ট কথা, মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজটি একমাত্র আল্লাহর। অতএব কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেন, নিজের মৃত্যু ঘটান নিজের হাতে তবে তিনি অনধিকার চর্চাই করবেন। আল্লাহ তা পছন্দ করেন না। কেউ অনধিকার চর্চা প্রত্যাশা করে না। ইসলামে তাই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়েছে। এ কাজ থেকে বিরত থাকতে মহান আল্লাহ বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং এর পরিণামের কথা ভাববার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে মহা পবিত্র কোরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। ‘আর তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করব, আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।’ -সুরা আন নিসা : ২৯-৩০

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ কোরো না।’ -সুরা বাকারা : ১৯৫

হাদিসের বার্তা

হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসংখ্যা হাদিসে আত্মহত্যা থেকে বিরত থাকার জন্য নানাভাবে বারণ করেছেন। এ থেকে মানুষকে সতর্ক করেছেন। যেমন- হজরত সাবিত বিন যাহহাক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে আত্মহত্যা করল- আল্লাহতায়ালা তাকে জাহান্নামে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি দেবেন।’ -সহিহ বোখারি : ১৩৬৩, ৬০৪৭, ৬১০৫, ৬৬৫২

অন্য হাদিসে রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে তার বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।’ -সহিহ বোখারি : ৫৪৪২

হজরত জুনদাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জনৈক ব্যক্তি গুরুতর আহত হলে সে তার ক্ষতগুলোর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করল। অতঃপর আল্লাহতায়ালা বললেন, আমার বান্দা স্বীয় জান কবজের ব্যাপারে তড়িঘড়ি করেছে; অতএব আমি তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ -সহিহ বোখারি : ১৩৬৪

মৃত্যু কামনা বৈধ নয়

আত্মহত্যা তো দূরের কথা ইসলাম কোনো বিপদে পড়ে বা জীবন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করতে পর্যন্ত বারণ করেছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন কোনো বিপদে পতিত হয়ে মৃত্যু কামনা না করে। মৃত্যু যদি তাকে প্রত্যাশা করতেই হয় তবে সে যেন বলে, হে আল্লাহ! আমাকে সে অবধি জীবিত রাখুন, যতক্ষণ আমার জীবনটা হয় আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে তখনই মৃত্যু দিন যখন মৃত্যুই হয় আমার জন্য শ্রেয়।’ -সহিহ বোখারি : ৫৬৭১

আত্মহত্যা রোধে করণীয়

মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন এক রকম কাটে না। ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্রই পরিবর্তন হতে থাকে। কখনো দিন কাটে সুখে, কখনো কাটে দুঃখে। কখনো আসে সচ্ছলতা। আবার কখনো দেখা দেয় দরিদ্রতা। কখনো থাকে প্রাচুর্য কখনো আবার অভাব-অনটন। কখনো ভোগ করে সুস্থতা কখনো আক্রান্ত হয়ে পড়ে রোগ-শোকে। কখনো দেখা দেয় সুদিন, আবার কখনো আসে দুর্ভিক্ষ। কখনো আসে বিজয়, আবার কখনো আসে পরাজয়। কখনো আসে সম্মান আবার কখনো দেখা দেয় লাঞ্ছনা। এ অবস্থা শুধু বর্তমান আমাদের সময়েই হয়ে থাকে, তা নয়। এটা যুগ যুগ ধরে এভাবেই আবর্তিত হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারপর আমি মন্দ অবস্থাকে ভালো অবস্থা দ্বারা বদলে দিয়েছি। অবশেষে তারা প্রাচুর্য লাভ করেছে এবং বলেছে, আমাদের বাপ-দাদাদেরও দুর্দশা ও আনন্দ স্পর্শ করেছে।’ -সুরা আল আরাফ : ৯৫

আরও পড়ুন: রজব থেকেই রমজানের প্রস্তুতি

যেহেতু বিপদ-আপদ, কষ্ট-শোক মানুষের নিত্যসঙ্গী তাই সমাজ থেকে আত্মহত্যা নির্মূলে প্রথমত দরকার পুরো সমাজব্যবস্থায় ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তব অনুশীলন। কারণ, মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় হতাশার চরম মুহূর্তে। আর অনুশীলনরত মুসলিম জীবনে হতাশার কোনো স্থান নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলো, হে আমার বান্দারা! যারা নিজদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ -সুরা আয যুমার : ৫২

যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যাবতীয় ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ যা-ই করেন বান্দার তাতে কোনো না কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে, সে কখনো নিজের জীবন প্রদীপ নিজেই নিভাবার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সে তো হাজার বিপদেও অবিচল থাকবে এ বিশ্বাসে যে আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করছেন। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে অবশ্যই তিনি আমাকে পুরস্কৃত করবেন। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রথম দরকার ইসলামি শিক্ষা এবং দৈনন্দিন জীবন ইসলামের বাস্তবানুশীলন।


মন্তব্য