দেশের মোবাইল সিম বিদেশে ব্যবহার করা যায় যেভাবে

ফোনকল
অনেকেই বিদেশি সিম নেয়ার বদলে দেশের মোবাইল সিম বিদেশের মাটিতে ব্যবহার করতে চান  © সংগৃৃহীত

নানা কাজের সূত্রে বিদেশে যাওয়ার সময় দেশে ব্যবহৃত মোবাইল সিমটি সাথে নেয়ার প্রয়োজন হয়। অর্থ বিড়ম্বনাসহ বিভিন্ন কারণে অনেকেই বিদেশি সিম নেয়ার বদলে দেশের মোবাইল সিম বিদেশের মাটিতে ব্যবহার করতে চান।

এর জন্য প্রথমেই জানতে হবে মোবাইল নেটওয়ার্কের একটি কারিগরি দিক, যা আন্তর্জাতিক রোমিং নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে দেশীয় সিমটিতে রোমিং সিস্টেম সক্রিয় করে দেশের বাইরে সিমটি ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সাথে বিভিন্ন ধরনের শর্ত এবং পূর্বপ্রস্তুতি মূলক কার্যকলাপ রয়েছে। চলুন, দেশের মোবাইল সিম বিদেশের মাটিতে ব্যবহারের সেই দিকগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।

আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম কি?
আন্তর্জাতিক মোবাইল রোমিং হল এমন একটি পরিষেবা যা স্মার্টফোনসহ অন্যান্য মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারকারীদের অন্য দেশে যাওয়ার সময় ভয়েস কল এবং টেক্সট মেসেজ পাঠানো এবং গ্রহণ, ইন্টারনেট ব্রাউজ এবং ইমেল পাঠানো ও গ্রহণ করতে সহায়তা করে।

রোমিং দেশীয় অপারেটরের খুচরা ভয়েস এবং এসএমএস পরিষেবাগুলোর কভারেজ প্রসারিত করার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটি সমাধা করে। একটি মোবাইল ব্যবহারকারীর দেশীয় অপারেটর এবং বিদেশি অপারেটর নেটওয়ার্কের মধ্যে একটি পাইকারি রোমিং চুক্তির মাধ্যমে কভারেজের বিরামহীন প্রসারণ সম্ভব করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম কিভাবে কাজ করে
যখন একজন মোবাইল ব্যবহারকারী বিদেশে যেয়ে তার মোবাইল ডিভাইসটি চালু করেন, তখন সেটি সেখানকার স্থানীয় মোবাইল নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। বিদেশি নেটওয়ার্কটি নবাগত ব্যবহারকারীর মোবাইল থেকে সংযোগ গ্রহণ করে। অতঃপর এটি তার সিস্টেমের সাথে নিবন্ধিত কিনা তা শনাক্ত করে ব্যবহারকারীর দেশীয় নেটওয়ার্ক শনাক্ত করার চেষ্টা করে। 

যদি দেশ দুটির মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে একটি রোমিং চুক্তি থাকে, তাহলে কলটি বিদেশি নেটওয়ার্কটি দ্বারা একটি আন্তর্জাতিক ট্রানজিট নেটওয়ার্কের দিকে রুট করা হয়। আন্তর্জাতিক ট্রানজিট নেটওয়ার্ক ক্যারিয়ার গন্তব্য নেটওয়ার্কে কল ডেলিভারি সম্পন্ন করে। এটি হয়ে গেলে অন্যদিকে গন্তব্য নেটওয়ার্কটি কলটি সংযুক্ত করে। 

বিদেশি নেটওয়ার্কটি দেশীয় নেটওয়ার্ক থেকে ব্যবহারকারী সম্পর্কে পরিষেবার তথ্যও অনুরোধ করে, যেমন ব্যবহৃত ফোনটি হারিয়ে গেছে বা চুরি হয়েছে কিনা এবং মোবাইল ডিভাইসটি আন্তর্জাতিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত কিনা। 

ফোনটি ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হলে বিদেশি নেটওয়ার্ক ডিভাইসটির জন্য একটি অস্থায়ী গ্রাহক রেকর্ড তৈরি করে। একই সাথে দেশীয় নেটওয়ার্ক ডিভাইসটি কোথায় অবস্থিত তার গ্রাহক রেকর্ড আপডেট করে, যাতে ফোনে কল করা হলে এটি যথাযথভাবে রাউট করা যায়।

এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ধরা যাক কোন এক বাংলাদেশি আমেরিকায় গেলেন। তখন তার মোবাইল সিমটি যদি আমেরিকার মোবাইল নেটওয়ার্ক কর্তৃক অনুমোদিত হয়, তবে আমেরিকার সবচেয়ে শক্তি শালি নেটওয়ার্ক সিস্টেমের সাথে সেটি সংযুক্ত হয়ে যাবে। 

অতঃপর বাংলাদেশ ও আমেরিকা উভয় দেশের অপারেটর গ্রাহকটির যাবতীয় তথ্য হালনাগাদ করবে। বাংলাদেশি সিমটির সেবা ব্যবহারের চার্জ ধার্য হবে আমেরিকার কল রেট অনুযায়ী। এ সময় সিমটিতে যাবতীয় ইনকামিং-আউটগোয়িং-এর জন্য চার্জ ধার্য হবে।

দেশের সীম বিদেশের মাটিতে ব্যবহার করার নিয়মসমূহ

রোমিং সার্ভিস সক্রিয় করার উপায়
সিম কার্ডে আন্তর্জাতিক রোমিং সক্রিয় করতে হলে ব্যবহৃত মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানির অফিসে যেতে হবে। এ সময় যা যা প্রয়োজন হবে তা হলো-

*ন্যূনতম ৬ মাস মেয়াদের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড (উভয় দিকের ফটোকপি)

*প্রিপেইড সিমের জন্য সঠিকভাবে পূরণকৃত আইআরএফ (আন্তর্জাতিক রোমিং ফর্ম)

*আইএসডি (আন্তর্জাতিক সাবস্ক্রাইবার ডায়ালিং) সংযোগসহ প্রিপেইড সংযোগের সাবস্ক্রিপশন নথির ফটোকপি

*পাসপোর্টের ফটোকপি(প্রথম পাঁচ পৃষ্ঠা)

*ব্যবহারকারির দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি

*আন্তর্জাতিক কারেন্সি অ্যাকাউন্ট-এ শুরুতে স্ট্যান্ডার্ড প্রিপেইড রোমিং সার্ভিসের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২৫ ডলার জমা রাখতে হবে। পরবর্তীতে প্রতিবার ১০ ডলার জমা করা যাবে।

এই সকল কাগজপত্র জমাদানের পর সিম কোম্পানি থেকে আন্তর্জাতিক রোমিং সার্ভিস চালু করে দিবে।

দুই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে সামঞ্জস্যতা
মোবাইল এর নেটওয়ার্কের ধরন তথা জিএসএম ৯০০/১৮০০/১৯০০/অন্যান্য সংস্করণগুলো অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে বিদেশী নেটওয়ার্কের ধরনের সাথে। এর জন্য বিদেশ যাত্রার পূর্বে সঠিক মোবাইল নেটওয়ার্ক বা সিম কোম্পানি নির্বাচন করে নিতে হবে। এই কাজটি দুটি উপায়ে করা যায়-

প্রথমত, মোবাইল নেটওয়ার্ক বা অপারেটর সিলেকশন অপশনটি যদি অটোমেটিক করা থাকে, তাহলে মোবাইল নিজে থেকেই বিদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হয়ে যাবে। চলাফেরার সময় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নেটওয়ার্কের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে হ্যান্ডসেটটি নিজে থেকেই নেটওয়ার্ক পরিবর্তন করে নিবে। অতএব আশেপাশে যেখানেই নেটওয়ার্ক সিস্টেম ভালো হবে সেটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে সংযুক্ত হয়ে যাবে।

দ্বিতীয়ত, মোবাইল নেটওয়ার্ক বা অপারেটর সিলেকশন অপশনটি ম্যানুয়েল হলে ব্যবহারকারিকে একটি নেটওয়ার্ক বেছে নেবার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম সক্রিয় করতে হবে।

আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম চালু করার পদ্ধতি
মোবাইল অপারেটরের ওপর নির্ভর করে প্রথমে এর নেটওয়ার্ক সিলেকশন, ফোন সেটআপ বা সেটিংস মেনুতে প্রবেশ করতে হবে। এরপর সার্চ করলে বেশ কিছু সময় ধরে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিভিন্ন নেটওয়ার্ক খুঁজতে থাকবে। আশেপাশে কোন নেটওয়ার্ক থাকলে তা মোবাইলের স্ক্রিণে দেখাবে এবং সেগুলোর মধ্যে থেকে যে কোনটিতে প্রেস করে নেটওয়ার্কটির সাথে সংযুক্ত হওয়া যাবে।

আন্তর্জাতিক অ্যাক্সেস কোড
এবার সিমটি ব্যবহার অর্থাৎ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে বা অন্যান্য দেশে কল করতে প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক অ্যাক্সেস কোড। এর মাধ্যমে সহজেই সিমটি ব্যবহার করে অন্যান্য দেশগুলোতে কথা বলা যাবে। অধিকাংশ দেশের অ্যাক্সেস কোড হলো- + (প্লাস) বা ০০। এই আন্তর্জাতিক অ্যাক্সেস কোড (+ ০০)-এর পর কাঙ্ক্ষিত দেশের কান্ট্রি কোড দিয়ে ফোন নাম্বারটি ডায়াল করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- + তারপর ৬০(কান্ট্রি কোড) এবং সবশেষে (ফোন নাম্বার) ০০ ৬০(ফোন নাম্বার)। নিম্নে বিভিন্ন দেশের অ্যাক্সেস কোড উল্লেখ করা হলোঃ

যুক্তরাষ্ট্র- ০১১, কানাডা- ০১১ +, জর্জিয়া- ৮১০ +, হংকং- ০০১ +, সিঙ্গাপুর- ০০১(সিংটেল); ০০২(মোবাইলওয়ান); ০০৮(স্টারহাব), কাতার- ০০, সৌদি আরব- ০০, থাইল্যান্ড- ০০১, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস- ০১১, সেন্ট লুসিয়া- ০১১, সেইন্ট ভিনসেন্ট- ০১১, জার্মানি- ০০, মালয়শিয়া- ০০, ক্যামেরুন- ০০৭ ০০১, আবখাযিয়া- ৮১০ +, অ্যাঙ্গুইলা- ০১১, ক্যাম্বোডিয়া- ০০৭ ০০১, কেম্যান আইল্যান্ড- ০১১, গ্রানাডা- ০১১ +, ইন্দোনেশিয়া- ০০১ / ০০৭ / ০০৮, কেনিয়া- ০০০, নাইজেরিয়া- ০০৯, প্যারাগুয়ে- ০০২ +, ব্রাজিল- ০০১৪, দক্ষিণ আফ্রিকা- ০৯, তানজানিয়া- ০০০, তাজিকিস্তান- ৮১০, উগান্ডা- ০০০ +, উজবেকিস্তান- ৮১০|

আন্তর্জাতিক রোমিং সার্ভিস এর মাধ্যমে এসএমএস পাঠানো
বিদেশে যাবার পর দেশীয় সিম দিয়ে সেই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ম্যাসেজ পাঠানোর জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।

প্রথমে যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সেটি হচ্ছে, যার কাছে এসএমএসটি যাবে তার মোবাইল নম্বর যেন অবশ্যই আন্তর্জাতিক ফর্ম্যাটের হয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক অ্যাকসেস কোড + অথবা ০০, তারপর কান্ট্রি কোড এবং সবশেষে মোবাইল ফোন নম্বর দিন। এখানে যেসব দেশের কান্ট্রি কোডের শেষে শূন্য এবং মোবাইল ফোন নাম্বার শূন্য দিয়ে শুরু, সেসব দেশের জন্য কান্ট্রি কোডের শূন্যের পর মোবাইল ফোনের শূন্য দেয়া যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের গ্রামীণফোনের কোন নাম্বারে এসএমএস পাঠাতে হলে, +৮৮০-এর পর মোবাইল ফোন নাম্বারের বাকি দশটি ডিজিট দিতে হবে।

এমনকি এসএমএস সেন্টারের নাম্বারও আন্তর্জাতিক ফরমেটে সেভ করে রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম সার্ভিস-এর বদৌলতে একবার এসএমএস সেন্টারের নাম্বার আন্তর্জাতিক ফর্ম্যাটে সেইভ করার পর তা আর পরিবর্তন হয় না। পরবর্তীতে সেই দেশ থেকে অন্য দেশে বা নিজের দেশে ফেরত এলেও ম্যাসেজ পাঠানোর জন্য নতুন করে আর নাম্বারটি পরিবর্তন করতে হয় না। বাংলাদেশে যেভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে এসএমএস লেনদেন হতো, ঠিক সেভাবেই সব জায়গাতেই এসএমএস পাঠানো যাবে।

পরিশিষ্ট
দেশের মোবাইল সিম বিদেশের মাটিতে ব্যবহারের পূর্বে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা জরুরি। সদ্য দেশ থেকে বিদেশে যাওয়া লোকদের জন্য আর্থিক দিকটিকে বেশি আমলে নিয়ে তুলনামুলকভাবে ভালো কোন বিকল্পের দিকে লক্ষ্য দেয়া উচিত। কেননা উপরোক্ত তথ্যগুলো এ বিষয়টি নিশ্চিত করে যে, আন্তর্জাতিক রোমিং ব্যবস্থা নিয়ে ঝামেলাহীন সেবা দিতে বাংলাদেশের টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির এখনও বেশ সময় লাগবে।

সূত্র: ইউএনবি


মন্তব্য