ইমরান খানকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান কি সম্ভব?

ইমরান খান
  © সংগৃহীত

সন্দেহ নেই, পাকিস্তান আজ যেভাবে দুই ভাগ হয়ে গেছে, তা অতীতে কখনোই দেখা যায়নি। ইমরান খানের বিরুদ্ধে রাজধানীর একটি আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইসলামাবাদ পুলিশ কার্যকর করতে যাওয়ার পর গোটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

লাহোরে জামান পার্ক আবাসিক এলাকায় ইমরানের বাড়িতে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে গেলে তাঁর সমর্থকেরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাদের ইটপাটকেলের আঘাতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। এ সময় পুলিশের পক্ষে দূর থেকে কয়েক ডজন কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া ছাড়া আর তেমন কিছুই করার ছিল না।

ইমরানের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এখনো কার্যকর করা যায়নি এবং ইমরান সমর্থকেরা এখনো বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁদের কারও কারও হাতে বন্দুক এবং পেট্রলবোমা দেখা গেছে।

নিম্ন আদালত থেকে যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, সেটি বাতিল করতে প্রথমে লাহোরের এবং পরে ইসলামাবাদের হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করেন। আমার আইনি প্রশিক্ষণ নেই, সে কারণে আমি বুঝতে পারছি না কীভাবে, কেন এবং কোন প্রক্রিয়ায় ইসলামাবাদ হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের আদেশে হস্তক্ষেপ করলেন এবং মামলার শুনানির আগপর্যন্ত গ্রেপ্তারের আদেশকে স্থগিত করলেন।

এ সফল প্রতিরোধকে যখন পিটিআই সমর্থকেরা উদ্‌যাপন করছেন, তখন পিটিআইবিরোধীরা আদালতের আদেশ কার্যকরে কর্তৃপক্ষ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন। ইমরানবিরোধীরা এটিকে আইনের সঙ্গে তামাশা বলে আখ্যায়িত করছেন। একই সঙ্গে এটিকে তাঁরা নৈরাজ্যবাদীদের কাছে সরকারের নতজানু হওয়া হিসেবে দুয়োধ্বনি দিচ্ছেন।

প্রধানত এ দুটি বিষয়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। কিন্তু যে বিষয়টি আলোচনার আড়ালে রয়ে যাচ্ছে, তা হলো ইমরানকে সেদিন যে পুলিশ সদস্যরা গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই কেন অস্ত্রবিহীন অবস্থায় ছিলেন এবং পুলিশ সদস্যরা যদি অস্ত্রসজ্জিত হয়ে সেদিন ঘেরাও করে রাখতেন, তাহলে তার পরিণতি হিসেবে কী ঘটতে পারত।

জামান পার্কে সংঘর্ষের সময় ইমরান খানের জন্য জান বাজি রাখা সশস্ত্র সমর্থকদের পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার যে দৃশ্য দেখা গেছে, তা ৩০ বছর আগেকার একটি ভয়ানক ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়।

মনে পড়ছে টেক্সাসের ওয়াকো এলাকার কথা। ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যালকোহল, টোব্যাকো অ্যান্ড ফায়ারআর্মস ব্যুরোর কর্মকর্তারা ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান সম্প্রদায়ের নেতা ডেভিড কোরেশের বিরুদ্ধে আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারাদেশ বাস্তবায়নে তাঁর আস্তানায় হানা দেন। ডেভিড কোরেশ তাঁর সশস্ত্র সমর্থকদের পুলিশের ওপর পাল্টা হামলা চালাতে বলেন। এতে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় এবং পাল্টাপাল্টি গুলিতে চারজন কর্মকর্তা ও পাঁচজন ডেভিড অনুসারী নিহত হয়।

এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৫০ দিন পর্যন্ত পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছিল। এরপর এপ্রিল মাসের একদিন সারা কম্পাউন্ডে আগুন জ্বলে উঠতে দেখা গেল। কারা ওই আগুন জ্বালিয়েছিল, তা জানা যায়নি। কিন্তু সেই ভয়াবহ আগুনে ডেভিড কোরেশ ও তাঁর ৭৫ জন অনুসারী পুড়ে মরেন, যাঁদের মধ্যে দুজন অন্তঃসত্ত্বাসহ ২৫ জন নারী ছিলেন। এফবিআইয়ের দাবি, ওই সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রেপ্তার এড়াতে নিজেরাই আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

যেহেতু জামান পার্ক চত্বরে ইমরান খানের সমর্থকদের অনেকে সশস্ত্র ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, সেহেতু ধরে নেওয়া যায়, সেদিন যদি পুলিশ সশস্ত্র অবস্থায় সেখানে যেত এবং ইমরানকে গ্রেপ্তার করতে বদ্ধপরিকর থাকত, তাহলে সেখানে আরও অনেক বড় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটতে পারত।

ইমরান খানের গ্রেপ্তারাদেশ স্থগিত করাকে অনেকে ‘ইমরান খানপন্থী’ রায় বলে আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলব, আদালতের এ সিদ্ধান্ত একদম সঠিক ছিল; এর মাধ্যমে বড় ধরনের রক্তারক্তি বন্ধ করা গেছে।

গত কয়েক বছরের মধ্যে ইমরান খানই প্রথম নেতা, যিনি বলেছেন দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি ‘যে কারও’ সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি। তাঁর এ আলোচনার প্রস্তাবে ‘চোর’ ও ‘ডাকাত’দের মতো ছলনার সুর দেখা যায়নি। ইমরানের এ আলোচনার প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে এগোতে হবে। কারণ, পাকিস্তানের চলমান সংকট নিরসনে শান্তিপূর্ণ আলোচনা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

আব্বাস নাসির, ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক
প্রথম আলো অনূদিত


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ