আয়ান ও আয়হামের পরিবারে নেই ঈদ আনন্দ

মুসলমানি
  © ফাইল ছবি

দুদিন পরে ঈদ। সবার ঘরে আনন্দ। বাইরে শেষরাত পর্যন্ত কেনাকাটার ব্যস্ততা। বাবা-মায়ের হাত ধরে শিশুরাও ভিড় করছে শপিংমলে। আর ছোট্ট সোনাদের আবদার পূরণে পরিবারের কতশত আয়োজন। উৎসবের রঙে বর্ণিল যখন গোটা দেশ, তখন কোনো আনন্দ আয়োজনের বালাই নেই আয়ান ও আয়হামের পরিবারে। 

বছরের শুরুতে খতনা করাতে গিয়ে ভুল অ্যানেসথেসিয়ায় মারা যায় দুই শিশু। শোকে-বিষাদে তাদের স্মৃতি আঁকড়ে আছে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা। সে স্মৃতি যেন কুঁড়ে খাচ্ছে। তাই দুই পরিবারেই এবার নিরানন্দের ঈদ। 

রোববার সন্ধ্যায় কথা হয় রাজধানীর সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু হওয়া পাঁচ বছরের আয়ান ও মালিবাগ জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে মারা যাওয়া স্কুলশিক্ষার্থী আয়হামের পরিবারের সঙ্গে। চারপাশে কেনাকাটার ধুম লাগার দৃশ্য সন্তানের মৃত্যু বেদনায় বিষাদের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।

আয়হামের মা চুমকি ঈদের প্রস্তুতির কথা জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জানান সন্তানের গত বছরের ঈদস্মৃতি। তিনি বলেন, ঈদ আর নেই। আমার বাপজানের (শিশু আয়হাম) মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে। গত বছরও বাপজানের কত বায়না। পাঞ্জাবি কিনে দিতে হবে। শার্ট-প্যান্ট লাগবে। আবার টি-শার্টও দিতে হবে। অনেকগুলো খেলনা লাগবে। এবার আমার বাপজান মাটিতে ঘুমিয়ে আছে। আমার জীবন থেকে ঈদ হারিয়ে গেছে। ঈদে কোনো কেনাকাটা করতে ইচ্ছে করছে না। ছোটভাই আয়মানও ভাইকে ছাড়া কিছুই কিনতে চাইছে না। ঈদের দিনের পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ঈদের দিন সকালে ঢাকায় থাকা হবে। নামাজের পর কুমিল্লা যাব। বাবার কবরের পাশে গিয়ে ঈদ করব!

মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি জানান, আসামিরা বিভিন্ন আদালতে ধরনা দিচ্ছে জামিনের জন্য। তারা চাইছে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু আমরা সন্তান হারিয়েছি। সে কোনোদিন ফিরবে না। তবে এ চিকিৎসকরা যেন আর কোনোদিন কারও ক্ষতি না করতে পারে তাই উপযুক্ত শাস্তি চাইছি। জানি না লড়াইটা কতদিন চালিয়ে যেতে পারব।

ইফতারের পর কথা হয় শিশু আয়ানের বাবা রূপগঞ্জের বরুনার বাসিন্দা শামীম আহমেদের সঙ্গে। একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে এখনো শোকে পাথর তিনি। বরিশালে আদি নিবাস হলেও সন্তানকে দাফন করেন বরুনা বাজারসংলগ্ন স্থানীয় কবরস্থানে। তাই এবার গ্রামে যাননি। ঈদের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, আয়ানকে কোলে নিয়ে ঈদগাহে যেতাম। শখ করে পছন্দের পাঞ্জাবি কিনে দিতাম। একমাত্র পুত্রের সঙ্গে নিজেও কালার ও ডিজাইন ম্যাচিং করে কেনাকাটা করতাম। কিন্তু এখন আর কোনো ইচ্ছে নেই। ঈদ আর ঈদ নেই আমাদের।

মামলার প্রসঙ্গে তিনি জানান, ভুল চিকিৎসায় সন্তান হারিয়ে ইউনাইটেডের মতো প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে হুমকি পেয়েছি। অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে বলা হচ্ছে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাসা থেকে তুলে নেবে। থানায় জিডিও করেছি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের অসহযোগিতার শিকার হয়েছি। সন্তান হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে আমি হতাশ; কিন্তু হাল ছাড়ব না। আমার তো হারানোর কিছু নেই। তিনি আরও বলেন, আয়হামের ঘটনায় তো দোষীরা গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু আয়ানের মৃত্যুতে সংশ্লিষ্টরা দিব্যি ঘুরে বেরাচ্ছে। তারা প্রভাবশালী বলে আইনের বাইরে থেকে গেছে। আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিচার হলে আয়হামকে হয়তো হারাতে হতো না।

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন আহনাফ তাহমিদ আয়হাম (১০)। রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট মোড়ে তিলপাপাড়া সড়কের (প্রথম বাসা) চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকে আয়হামের পরিবার।

ফখরুল-চুমকি দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে আয়হাম বড়। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাবার সঙ্গে খতনা করাতে গিয়েছিল মালিবাগ জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে। ছোট অস্ত্রোপচারে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া না দিয়ে ফুল অ্যানেসথেসিয়া দেন চিকিৎসক। এতে আর জ্ঞান ফেরেনি আয়হামের। মারা যায় সে। দুরন্ত সন্তানের নিথর লাশের কফিন ওঠে বাবার কাঁধে। পরিবারের কাছে মায়ের একান্ত অনুগত ছেলে ছিল আয়হাম। বলা হতো, সে হয়েছে মায়ের মতোই। ঘটনার দিন কালো প্যান্ট, কালো টিশার্ট ও একই রঙের জুতা পরে বাচ্চাটা গিয়েছিল। হাসিমুখে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকল আর বের হলো লাশ হয়ে।

এর আগে, বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুল ছুটিতে বাবা শামীম আহমেদের সঙ্গে গত ৩০ ডিসেম্বর সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করতে যায় পাঁচ বছরের আয়ান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ৩১ ডিসেম্বর খতনা-পূর্ব অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়। এর আট দিন পরও জ্ঞান ফেরেনি শিশুটির। উন্নত চিকিৎসার জন্য গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করে মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরে ৭ জানুয়ারি রাত ১১টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসায় ব্যয় ধরা হয় ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৭ টাকা। আয়ানের মৃত্যুর পরও সে টাকা দাবি করে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। একমাত্র পুত্রসন্তানকে হারিয়ে গত সোয়া তিন মাসেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি শামীম আহমেদ-রেহানা আক্তার দম্পতি। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরুনায় গ্রামের বাড়িতে এখনো শোকের মাতম কাটেনি। বাড্ডা থানায় মামলা, উচ্চ আদালতে রিট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগের পর হাসপাতাল বন্ধ হলেও সন্তান ফিরে আসেনি। উল্টো বাড়তি পাওনা প্রাণনাশের হুমকি। প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা।


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ