সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, প্রতিকার কোথায়

সড়ক
  © ফাইল ছবি

দেশের সড়ক-মহাসড়কে ব্যাপক বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন হলেও সড়ক পরিবহন খাতে কোনো শৃঙ্খলা আসেনি। চার লেনের মহাসড়কে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিলাসবহুল বাস চলে। তার পাশেই চলে ব্যাটারিচালিত ধীরগতির বিপজ্জনক থ্রি-হুইলার, নসিমন, করিমন, ইজিবাইক।              

দ্রুতগতির যাত্রীবাহী বাসের সামনে হঠাৎ করে চলে আসে উল্টোপথের ছোট গাড়ি। ফলে বিশৃঙ্খল সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে বারবার ঘোষণা দিয়েও মহাসড়ক থেকে বিপজ্জনক যান সরানো যাচ্ছে না। কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা। এবারের দীর্ঘ ছুটির ঈদযাত্রায় সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে সড়কে। ঈদযাত্রার আগে পরে ১৪ দিনে অন্তত ২৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। দিনে গড়ে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে কোনো ঈদের সময়ই দুর্ঘটনায় এত বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়নি।

সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। অথচ সেই কাজের জন্য এই সংস্থার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছেন মাত্র ১০ জন। ফলে বেশিরভাগ কাজেই তাদের হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়।

আবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএর পক্ষ থেকে সড়ক নিরাপত্তায় যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার অধিকাংশই আলোর মুখ দেখে না। অবাধে সড়ক-মহাসড়কে চলছে নিষিদ্ধ যানবাহন। নিয়মনীতি না মেনে চলছে ৫০ লাখের বেশি মোটরসাইকেল। গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী নিষিদ্ধ যান কিংবা মোটরসাইকেল। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সড়কে মৃত্যুর প্রতিকার আসলে কোথায়— এমন প্রশ্ন সবার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লিফলেট বিতরণ আর নামমাত্র কিছু প্রশিক্ষণ ছাড়া সড়ক নিরাপত্তায় সরকারের বলার মতো কোনো কাজ নেই। তা ছাড়া বিভিন্ন এলাকার সড়ককে চার লেনে উন্নীত করেই আত্মতুষ্টিতে ভুগছে মন্ত্রণালয়। সড়কে সুশাসন ও আইনের শতভাগ প্রয়োগে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে স্থায়ী প্রতিকারের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণে নেই কোনো উদ্যোগ।

বিআরটিএ বলছে, সীমিত সামর্থ্য দিয়ে সারা দেশের সড়কপথ নিরাপদ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া বিআরটিএ, পুলিশ প্রশাসন কিংবা সাধারণ মানুষ—কোনো পক্ষই যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। মানা হচ্ছে না আইন। ফলে ধারাবাহিক দুর্ঘটনার প্রতিকারও মিলছে না।

বিআরটিএর সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ‘সারা দেশে অবৈধ যানবাহন অবাধে চলছে। পিকআপে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এসব দেখভালের দায়িত্ব তো বিআরটিএ একার নয়। একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করলে সংকট সমাধান হবে না। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

বিআরটিএর হিসাবে, ২০১৯ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪ হাজার ১৩৮ জন। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৪ জনে।

বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয় ৫ হাজার ২১১ জনের। গত বছর প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫২৪ জনে। বিআরটিএর হিসাবে, জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত গত তিন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৪৭৭ জনের। মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি। চলতি মাসের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ২৮৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৩২৪ জনের। আহতের সংখ্যা ৪২০। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, মার্চে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে ৪৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮৭ জন নিহত ও ৭১২ জন আহতের কথা বলছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের (এআরআই) হিসাবে, ১৯৯৮-২০১৩ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে ৬৬ হাজার ৬৬১টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন দায়ী। আর ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ২০ ভাগ আনফিট যানবাহন।

গত মঙ্গলবার ফরিদপুরের কানাইপুরের ইউনিক পরিবহনের একটি বাস যাত্রীসহ একটি পিকআপকে চাপা দেয়। এতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। পরে জানা যায়, বাসটির ফিটনেস ছাড়পত্র ও ট্যাক্স টোকেন কোনো কিছুই ছিল না। এমনকি যে সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেই রুটে চলাচলের অনুমোদনও ছিল না।

বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, অবৈধ নছিমন-করিমন, থ্রি-হুইলার, ফিটনেসবিহীন মোটরযান ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল সড়ক-মহাসড়কে চলাচল, মোটরযানের অতিরিক্ত গতি এবং মালবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন ইত্যাদি অনিয়মের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং ট্রাফিক পুলিশের অভিযান জোরদার করার মাধ্যমে এসব অনিয়ম বন্ধ করে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমাতে হলে ১৭ কোটি মানুষকে আইন মেনে চলতে হবে। আইন মানা ও দায়িত্ব পালনের জায়গায়, বিআরটিএ, পুলিশ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ কোনো পক্ষই মনযোগী নয়।’

তিনি বলেন, ‘বিআরটিএর সামর্থ্য সীমিত। ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে সারা দেশে অভিযান চালানো সম্ভব নয়। এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগানো হচ্ছে। সবাই এগিয়ে এলে দুর্ঘটনার প্রতিকার হবে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, জীবনের মূল্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে হবে না।’

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৯ লাখ ৮২ হাজার ৭৫৬টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৫০ লাখ ৬ হাজারের বেশি। রাজধানীতে নিবন্ধিত যান ২০ লাখ ৯৩ হাজার। ১১ লাখ ১৪ হাজার ৮০০ বেশি মোটরসাইকেল। নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে প্রায় সোয়া ৬ লাখের ফিটনেস নেই। অর্থাৎ ফিটনেস সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক যানবাহনের মধ্যে প্রায় ৩৯ ভাগ অবৈধভাবে চলাচল করছে। আবার যে পরিমাণ যানবাহন নিবন্ধিত, লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা তারচেয়ে ১২ লাখ কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল ব্যয় হলেও যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স নিশ্চিত করা, বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানো ও শ্রমিকদের মাদক গ্রহণ বন্ধ করা, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করা, সড়কের ত্রুটি দূর করা, অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করা এসব নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে দুর্ঘটনাও কমেনি।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠকে বসলে মনে হয় দেশে আর কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে না; কিন্তু মাঠের চিত্র ভিন্ন। সড়কের চিত্র একই থাকে। কথার কাজে কোনো মিল নেই। দুর্ঘটনা রোধে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য পাঁচটি পিলারের সবকটি ঘুনে ধরা। দুর্নীতির মধ্য দিয়ে সড়কে অব অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।’

দেশে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের শীর্ষ ফোরাম জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল (এনআরএসসি)। এই কাউন্সিল ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে নছিমন, করিমন, থ্রি-হুইলার, অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও সব অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিআরটিএ, জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশকে। তবে ৯ বছরেও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি।

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত অর্ধেকে নামিয়ে আনতে ২০০৮ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদি কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে আসছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। সেই ধারাবাহিকতায় এখন চলছে ২০২১-২৪ মেয়াদি কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন। সর্বশেষ ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাংক ৩৫ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা) ঋণ দিচ্ছে। এ ছাড়া সারা দেশে ১৭২টি স্থানে (ব্ল্যাক স্পট) সড়কের বাঁক সোজা করা হয়েছে; কিন্তু দুর্ঘটনা কমছে না।

বিআরটিএ পাশাপাশি সড়ক দেখভালের দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘সারা দেশে মহাসড়কের আয়তন ২২ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে হাইওয়ে পুলিশ ৩ হাজার কিলোমিটার দেখে। বাকি ১৯ হাজার কিলোমিটার দেখে জেলা পুলিশ ও মেট্রোপলিটন পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশের যানবাহন ও জনবল সংখ্যা কম।’

তিনি বলেন, ‘সড়ক নিরাপত্তার জন্য সবার সহযোগিতার দরকার। মালিক, চালকসহ প্রশাসনের লোকজন সমন্বিতভাবে সহযোগিতা করলে সড়ককে নিরাপদ রাখা সম্ভব।’


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ