শহরের বুকে মরুর গরম, ভোগান্তিতে দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ

তাপমাত্রা
  © সংগৃহীত

শহরের বুকে নেমে এসেছে মরুর গরম। বেশ কয়েক দিন ধরে সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা গড়ে ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রির মধ্যে বিরাজ করছে। এতে নাকাল সব বয়সি মানুষ। তীব্র দাবদাহে রাজধানীর খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ পড়ছেন চরম বিপাকে। অসহ্য গরমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। শপিংমল, মার্কেট কিংবা বাজারেও ক্রেতাসাধারণের উপস্থিতি কম। অনেকেই পূর্ণ সময়ের বদলে ঘণ্টা চুক্তিতে কাজ করছেন। শ্রমিকদের কেউ কেউ প্রত্যুষে কয়েক ঘণ্টা শ্রম দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশেই বিরাজ করছে। মালিকপক্ষ বা গৃহস্থদের ভাষ্য, বেশি টাকা দিয়েও মিলছে না শ্রমিক। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমের উত্তাপ সইতে না পেরে কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। তাদের ভয়, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেল।

টানা দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গরমের সাধারণ ও কর্মজীবী মানুষের ভোগান্তি আর কষ্ট বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। তীব্র রোদের কারণে দিনমজুর, রিকশাচালক ও ভ্যানচালকরা কাজ করতে পারছেন না। এদিকে কাজ না করলে খাবার জুটবে না। তাই পেটের তাড়নায় প্রচণ্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে কাজে বেরিয়েছেন অনেকে। গরম উপেক্ষা করে বের হলেও অনেকেই হাঁসফাঁস করছেন।

বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, তীব্র গরমে নাজেহাল অবস্থা প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের। বিশেষ করে শ্রমজীবী ও কর্মজীবীদের জীবন যেন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তার পরও জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘাম ঝরিয়ে ছুটতে হচ্ছে তাদের। কেউবা কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছেন ছায়ার নিচে। গরমের কারণে দীর্ঘসময় কাজ করতে না পারায় কমে গেছে তাদের আয়ের পরিমাণও। গরমের কারণে কষ্ট কয়েকগুণ বাড়লেও আয় বাড়েনি।

কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে রাজধানীর বারিধারা সড়কে অপেক্ষা করছিলেন দিনমজুর আসিফ মিয়া ও আবদুল কাদের। সঙ্গে টুকরি-কোদাল। তারা জানান, বাড়িধারা, মধ্যবাড্ডা, তেজগাঁও, শাহজাহানপুর, আজিমপুরসহ অনেক জায়গায় শত শত দিনমজুর কাজের সন্ধ্যানে ভোর থেকেই অপেক্ষা করেন। কিন্তু গত ৭-৮ দিন ধরে অনেকেই আসছেন না।

আবাসন ও নির্মাণ সংস্থার কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন জানান, ৮-১০ দিন আগেও রাস্তার পাশে দিনমজুর পাওয়া যেত। এখন তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। আগে প্রতিদিন ভোরে বারিধারাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শত শত শ্রমিক অপেক্ষা করত, কখন ঠিকাদারের লোক আসবে। এখন আসছে হাতেগোনা কয়েকজন। শ্রমিক সংকটে নির্মাণের অনেক কাজ আটকে গেছে। শুধু তাই নয়, তীব্র গরমের কারণে অনেক ঠিকাদারও কাজ বন্ধ রেখেছেন। এ জন্য শ্রমিকরা আসছে না। হেলাল মিয়া নামে এক শ্রমিক জানান, তিনি এবং তার খালাতো ভাইসহ আরও তিনজন কাজ করতেন। এখন তারা চুক্তি অনুযায়ী ভোর থেকে ২-৩ ঘণ্টা কাজ করেন। 

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন জানান, রেল ও মহাসড়কে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে। কিন্তু কয়েক দিন ধরে শ্রমিকদের উপস্থিতি কমে গেছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজও শ্রমিকের অভাবে প্রত্যাশা অনুযায়ী চলছে না।

রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ফুটপাত ঘিরে শত শত অস্থায়ী দোকানপাট রয়েছে। কিন্তু তীব্র রোদের কারণে বের্শির ভাগ দোকান বন্ধ রয়েছে। যেগুলো খোলা রয়েছে, গরমের কারণে ক্রেতাশূন্য। 

কাপড় বিক্রেতা জসিম মিয়া জানান, সকাল থেকেই রোদ আগুনের মতো বাড়তে থাকে। দুপুর পর্যন্ত রাস্তায় থাকা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে দোকানপাট গুটিয়ে বাসায় চলে যান। চিকিৎসকরাও এই সময়ে খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতে নিষেধ করছেন। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানিসহ তরল খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

রাজধানীর বেইলি রোড ও নিউ মার্কেট এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতাদের আনাগোনা কম। নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী জহির আহমেদ জানান, গরমে ব্যবসা নেই বললেই চলে। স্বাভাবিক সময়ে যে পরিমাণ ক্রেতা সাধারণ নিউ মার্কেটসহ আশপাশের মার্কে আসত-বর্তমানে এর চার ভাগের এক ভাগও আসছে না। বেইলি রোডের ব্যবসায়ী জান্নাত নূর বলেন, কোনো ফ্যাশনহাউজেই ক্রেতা নেই। বিক্রি তলানিতে নেমেছে।

রাজধানীতে কয়েকজন বাসচালক ও হেলপারের সঙ্গে কথা হয়। চালক সিরাজুল জানালেন, বেশির ভাগ বাসেই যাত্রী সংখ্যা হাতেগোনা। সকালের দিকে কিছু যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। সন্ধ্যার পরও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দিনের বেলা যাত্রীদের দেখা মিলছে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া এই গরমে মানুষ বাসার বাইরে বের হচ্ছেন না-যার প্রভাব পড়ছে গণপরিবহণেও।

পরিবেশবিদরা বলছেন, গরমের এই অস্বস্তিকর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বায়ুদূষণও দায়ী। শুকনো আবহাওয়ায় এমনিতেই বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি থাকে। বাড়তে থাকে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ। গরমের সঙ্গে দূষিত কণাও মানুষের অস্বস্তির কারণ। 

স্থপতি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব বলেন, দেশে শুধু গাছ নয়, ঘাসও নষ্ট করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গাছের সঙ্গে ঘাসও হারিয়ে যাচ্ছে। ঘাস সরিয়ে ঢালাই, ইট দিয়ে ঢেকে দেয়া হচ্ছে মাইলের পর মাইল এলাকা। অপর দিকে জলীয়বাষ্পের জোগান না থাকায় শহরে মারাত্মক গরম হাজির হয়েছে। এর জন্য দায়ী আমরাই। ঢাকা দূষণের শহর হওয়ায় রোদের তাপ আরও শক্তিশালী হয়ে কামড় বসাচ্ছে-বললেন তিনি।

তিনি আরও জানান, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণও চরমে উঠছে। গরমের সঙ্গে দূষিত কণাও সব মানুষকে নাকাল করে ছাড়ছে। শ্রমিজীবী-শ্রমিক শ্রেণির মানুষের কষ্ট হচ্ছে বেশি। ইকবাল হাবিব আরও বলেন, ঘাসের লেয়ার থেকে অন্তত ৮-১০ ফুট উঁচ পর্যন্ত জলীয়বাষ্পের স্থর তৈরি করা, যা এ শহরে নেই। একই সঙ্গে গাছের কাজ হচ্ছে ছায়া দিয়ে অক্সিজেন তৈরি করা। এখন তো সব জায়গাই পাথরে ঢাকা। ফলে সূর্যের তাপ যখন পড়ছে তখন মরীচিকার মতো চকচক করছে। এতে করে উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডল তৈরি করছে। 

বায়ুদূষণে বাংলাদেশ এগিয়ে জানিয়ে তিনি বলেন, এর সঙ্গে বিভিন্ন রকমের গ্যাস যুক্ত হয়ে পারদের মতো অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে চার পাশ। মানহীন গণপরিবহণ থেকেও যুক্ত হচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস। ফলে সূর্যের তাপ স্বাভাবিকের চেয়ে আরও ৫-৬ ডিগ্রি বেশি উত্তপ্ত হয়ে ঢাকায় এখন চলাচল করাই দুরূহ হয়ে পড়েছে।

এদিকে প্রচণ্ড গরমে যাদের আয় কমে যাচ্ছে, তাদের সরকারি সহায়তা দেয়া উচিত বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, তাপদাহ হয়তো আরও কয়েকদিন চলবে। কিন্তু শুধু তাপদাহ নয়, ঝড় বৃষ্টি বন্যা সব কিছুতেই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা মানুষদের সমস্যা হয়। তাই শুধু তাপদাহ হচ্ছে এই বিবেচনা থেকে চিন্তা না করে, আমাদের দেখতে হবে বৃহত্তর পরিসরে।

সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে শ্রমজীবী মানুষকে যুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এরকম সময়ে যাদের রুটি-রুজির সমস্যা হচ্ছে, তাদের সহায়তা দেয়ার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আছে। এতে কীভাবে দিন আনে দিন খায় মানুষদের যুক্ত করা যেতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।

 


মন্তব্য