বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে পাহাড়ি বুনো গরু গয়াল পালন

গরু
  © সংগৃৃহীত

গরুর মতো দেখতে হলেও গয়ালের শিং দুপাশে ছড়ানো, সামান্য ভেতরমুখী বাঁকানো। শিংয়ের গোড়া অত্যন্ত মোটা। কালো গয়ালের হাঁটুর নিচ থেকে ক্ষুর পর্যন্ত সাদা লোমে ঢাকা। গয়ালের কুঁজ এতো বড় যে তার অবস্থান কাঁধ থেকে পিঠের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত। নাদুসনুদুস এ পশুর একেকটির দাম হাঁকা হচ্ছে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। 

দেশের বিভিন্ন গরুর গড় ওজন ২০০ থেকে ৪০০ কেজি। কিন্তু প্রতিটি গয়ালের গড় ওজন ৬০০ থেকে ৭০০ কেজি হয়। প্রতি বছর কুরবানির ঈদ এলেই চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় পশুরহাটে বিক্রি হয় গয়াল। কুরবানির পশু হিসাবে কেউ কেউ গয়াল কেনেন। ধীরে ধীরে চাহিদা বাড়ছে। একেকটির দাম হাঁকা হচ্ছে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল বলেন, দেশের একমাত্র বাণিজ্যিক গয়াল খামার রাঙ্গুনিয়ায়। একটি ভালো লক্ষণ। সাধারণত ১০-১১ মাস গর্ভধারণের পর মাদি গয়াল একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। গাভির মতো এদের ওলান নেই, স্তনবৃন্ত ছোট হওয়ায় এদের থেকে কখনো দুধ দোহানো যায় না। গয়ালের ব্যবহার জনপ্রিয় হলে দেশি-বিদেশি পশুর ওপর নির্ভরতা যেমন কমে আসবে, তেমনি গয়ালের বাণিজ্যিক লালনপালনে মানুষ আকৃষ্ট হবে। গয়ালের মাংসে কলেস্টেরল কম হওয়ায় এটি মানবদেহের জন্য সব সময় কম ঝুঁকিপূর্ণ। গয়াল শুধু দুর্বল খাবারেই লালন পালন করা হয়ে থাকে এবং এদের দেহে কোনো ধরনের কৃত্রিম ওষুধ প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে না। 

আরও পড়ুন: ‘সানভীস বাই তনি’ শোরুম সিলগালা কেন অবৈধ নয়, হাইকোর্টে রুল

গয়ালের মাংস সবার জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত বলেও জানান এ কর্মকর্তা। গয়াল খামারি এরশাদ মাহমুদ বলেন, একসময় গয়াল বন্যপ্রাণী হিসাবে বিবেচিত হতো। তখন এটি ফাঁদ পেতে বন থেকে ধরে এনে চোরাইপথে বেচাবিক্রি হতো। পরে বনবিভাগ গয়ালের ওপর থেকে বন্যপ্রাণীর পরিচিতি তুলে নিয়ে এটিকে গৃহপালিত গবাদিপশু হিসাবে ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে পশুটির বাণিজ্যিক পালন শুরু হয়। 

তিনি বলেন, ২০০৮ সালে পার্শ্ববর্তী রাঙামাটি জেলার গহিন বনের এক উপজাতি পরিবার থেকে তিনি তিনটি গয়াল কিনে এনেছিলেন। এর মধ্যে একটি বাচ্চা ও একটি মাদি গয়াল ছিল। এখন তার খামারে রয়েছে শতাধিক গয়াল। খামারের পাশে গোবর থেকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়েছে। বায়োগ্যাসের উচ্ছিষ্ট গোবর মাছের খাবার হিসাবে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৎস্য প্রজেক্টে দেওয়া হচ্ছে।

গহিন জঙ্গলের এই প্রাণী এখন কুমিল্লার সমতলভূমিতেও লালনপালন হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে গরুর পাশাপাশি গয়াল পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। গয়াল গভীর জঙ্গলের প্রাণী হলেও দেখতে গৃহপালিত গরুর মতো। বনে এদের বসবাস বলে এদের বনগরু বলা হয়। আকারে বিরাট।

কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বাসিন্দা সাকিউল হক আলভী। এক বছর আগে শখের বশে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দুটি গয়াল আনেন। নাম রাখেন বড় মিয়া ও ছোট মিয়া। বড় গয়ালটি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ও ছোট গয়ালটি ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় কিনে আনেন। গাড়ি ভাড়াসহ তার খরচ পড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

ফাতেমা অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক সাকিউল হক আলভী জানান, তার ফার্মে গরুর পাশাপাশি তিনি গয়াল লালনপালন করছেন। পরীক্ষামূলকভাবে পালন করা গয়াল দুটি থেকে ভালো মুনাফা হবে বলে আশা করছেন তিনি। 

গয়াল তৃণভোজী। হাতির মতোই গয়ালের খাদ্যাভ্যাস। শক্ত ও কর্কশ ঘাস খাওয়ার কারণে গয়ালের দাঁত দ্রুত ক্ষয় হয়। এই ক্ষয় পূরণে এদের ক্ষার ও লবণযুক্ত মাটি খেতে হয়। অবশ্য অন্ত্রের পোকা কমানোর জন্যও এরা লবণ খায়। এই অভ্যাসের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে লবণের টোপ ফেলে গয়াল শিকার করে পাহাড়িরা। তারপর পোষ মানানো হয়।

বর্তমানে কুমিল্লায় যেসব গয়াল দেখা যায়, তার বেশির ভাগই লবণের ফাঁদ দিয়ে শিকার করা বুনো গয়াল। কুমিল্লা নগরীর টমছমব্রিজ এলাকার বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম শাওন। তিনি একান্নবর্তী অ্যাগ্রো প্রজেক্টের মালিক। শাওন জানান, ছয়-সাত মাস আগে শখের বসে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে একটি গয়াল এনে লালনপালন করেছেন। গয়ালটির ওজন এখন ১৪ মণ ।

কুমিল্লা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, গরু লালনপালনের মতো করেই গয়াল পালন করা যায়। তবে গরুর চেয়ে গয়ালের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। কুমিল্লায় যারা গয়াল পালন করতে ইচ্ছুক, তারা চাইলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তার দপ্তর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে।