রেল ট্রানজিটে কার লাভ, কার ক্ষতি?

ট্রেন
  © ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে চলবে ভারতের ট্রেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সম্প্রতি যে ১০টি সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে, সেগুলোর একটি হচ্ছে এই রেল ট্রানজিট। ভারতের ট্রেন এতদিন বাংলাদেশের সীমান্তে এসে ইঞ্জিন পরিবর্তন করে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর বাংলাদেশের ইঞ্জিনে চলতো। কিন্তু এখন ভারতের রেলগাড়ি বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। আর এসব নিয়ে বুঝে না বুঝে কয়েকদিন ধরে উত্তাল নেট দুনিয়া।

ট্রানজিট বলতে আসলে কী বুঝায়?
ধরে নেই এ, বি, সি তিনটি দেশ। এখন এ যদি বি দেশের রাস্তা ব্যবহার করে সি’তে পণ্য পরিবহন করে তাহলে; বি, এ-কে ট্রানজিট সুবিধা দিলো। এখানে কিন্তু শুধু বি-দেশের ভূমি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যানবাহন হবে এ দেশের। আর এখানেই ট্রানজিট আর ট্রানশিপমেন্টের পার্থক্য।

ট্রান্সশিপমেন্ট এ মূল কথা হলো এক দেশে অন্য দেশের যানবাহন ঢুকবে না, সেক্ষেত্রে পণ্য সীমান্তে এসে বাহন পরিবর্তন করবে। যেমন ভারতের পণ্যবাহী জাহাজগুলো বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে এসে তাদের পণ্য খালাস করে। তারপর বাংলাদেশের ট্রাকগুলো সেই পণ্য বহন করে ভারতের আসাম-ত্রিপুরার সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে আবার ভারতের ট্রাকে তুলে দিয়ে আসে। এটা হলো ট্রান্সশিপমেন্ট।

আরও পড়ুন: পর্যটকহীন বান্দরবান, দীর্ঘশ্বাস পর্যটন সংশ্লিষ্টদের

 
রেল ট্রানজিট চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের গেদে থেকে ভুটান সীমান্তবর্তী ডালগাঁও পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন চালু করতে চায় ভারত। তার মানে হলো দর্শনা দিয়ে ঢুকে ঈশ্বরদী-আব্দুলপুর-পার্বতীপুর হয়ে চিলাহাটি পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতীয় ট্রেনটি আবার ভারতে প্রবেশ করবে। ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরীক্ষামূলকভাবে আগামী জুলাই মাসে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল চালানো হতে পারে।
 
বর্তমানে পাঁচটি রুটে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রেন চলে। তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ, বাকি দুটি পণ্যবাহী। বর্তমান নিয়মানুযায়ী, ভারতীয় ট্রেন সীমান্তে আসার পর বাংলাদেশি ইঞ্জিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসে। বাংলাদেশি চালক তা চালিয়ে আনেন। ফিরে যাওয়ার সময়েও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়।
 
প্রস্তাবিত রুটে ভারতের কতটা লাভ আর বাংলাদেশ কী পাবে:
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বগামী ট্রেন জলপাইড়গুড়ির ‘চিকেন নেক’ করিডোর ঘুরে যায়। বাংলাদেশের দর্শনা-ঈশ্বরদী-আব্দুলপুর-পার্বতীপুর-চিলাহাটী হয়ে গেলে ৩০০ কিলোমিটার পথ কমবে। এতে দেশটির পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় যাতায়াতে যেমন রেলপথের দূরত্ব কমে আসবে, তেমনি ট্রেনের পরিচালনা ব্যয়ও কমে আসবে বহুলাংশে।
 
এই ট্রানজিট কিন্তু নতুন নয়। কয়েকবছর আগেই দুটি রুটে ভারতকে পণ্য পরিবহনের অনুমতি বা ট্রানজিট দেয় বাংলাদেশ। আগের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, তখন বাহন পরিবর্তন করে স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আসতো। বাংলাদেশের যানবাহন আবার পণ্যগুলোকে ভারতের সীমান্তে দিয়ে আসতো। বলা যায়, ভারতের মালবাহী কোনো ট্রেন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সরাসরি যেতে পারতো না। এতে প্রচুর খরচ এবং সময় ব্যয় হতো আর এই সময়, খরচ কমাতেই ভারতের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষার ফলাফল এই রেল ট্রানজিট সুবিধা।
 
এছাড়া এই পথ দিয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত মিয়ানমারসহ আসিয়ানভুক্ত দেশে পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারবে। তবে আরেকটি কারণে এই চুক্তি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো তাদের ‘লুক ইস্ট পলিসি’। এশিয়াতে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে বাণিজ্য কার্যক্রম বৃদ্ধি ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
 
বাংলাদেশের স্বার্থ:
কূটনীতির ভাষায় এই চুক্তি বাংলাদেশের জন্য হতে পারে অন্যতম ‘বারগেইনিং টুল’। ‘নন ট্যারিফ বেরিয়ার’, সীমান্ত সমস্যা, সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি বা পানিবণ্টন চুক্তিসহ নানা ইস্যুতে এই ট্রানজিট সুবিধা হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম কূটনৈতিক হাতিয়ার। রিজিওনাল কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে ট্রানজিট ট্রানশিপমেন্ট এগুলো স্বাভাবিক বিষয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা।
 
এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে এমন বাণিজ্যিক রুট বহু আগে থেকেই প্রচলিত। তবে আসল কথা হলো কূটনৈতিকভাবে সুবিধার আদান-প্রদান কীভাবে হচ্ছে। অর্থনীতির ভাষায় এটি ‘জিরো সাম গেইম’ বা একপাক্ষিক লাভ নাকি দু-পক্ষের জন্যই ‘উইন উইন সিচুয়েশন’ তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে কয়েক বছর।
 
ইতোমধ্যে ২০২৪ সালের ২৩ জুন স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাতে বাধ সেধেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপধ্যায়। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রানজিট পাওয়ার পর দর্শনা থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত যে রেল লাইনটি ভারত ব্যবহার করার সুযোগ পাবে, সেটির উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার খরচও পাওয়া উচিত বাংলাদেশের।
 
এদিকে ২০২৬ সালে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে থাকবে না বাংলাদেশ। তখন শুল্কমুক্ত পণ্য পরিবহনের সুযোগ আর পাবে না বাংলাদেশ। এখন ভারতে পণ্য রফতানিতে যে ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্তির সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও নন ট্যারিফ বাধা রয়েছে, যে কারণে বহুলাংশে লাভ করতে পারছে না বাংলাদেশ। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও শুল্কমুক্ত অবস্থা বজায় রাখতে আলোচনা চলমান রয়েছে। যার নাম সেপা- কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ ও ভারত একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়। তাছাড়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক পলিসি হচ্ছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়।
 
২০২২ সালে ভারত বাংলাদেশকে বিনা মাশুলে তাদের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য পরিবহনের প্রস্তাব দিয়েছে৷ এতে করে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক ভারতের নির্দিষ্ট স্থলবন্দর ও পথ হয়ে নেপাল ও ভুটানে যেতে পারার কথা। কিন্তু সে সুবিধা এখনো পায়নি বাংলাদেশ। তাছাড়া ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কার্যকর হয়নি এখনো।
 
ট্রানজিট নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার একটি নীতি আছে।  যদি এ-দেশ চায় বি-দেশের ওপর দিয়ে সি-দেশে পণ্য পরিবহন করবে, তাহলে বি ট্রানজিট দিতে বাধ্য। কিন্তু যদি এ-দেশের আরেকটি অংশে যেতে যদি বি’র ওপর দিয়ে যেতে হয় হয় তাহলে বি ট্রানজিট দিতে বাধ্য নয়।
 
নেপাল ও ভুটান যথাক্রমে ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করেছিল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী, ভারত বাধ্য থাকলেও ভুটান বা নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধা বাংলাদেশকে দেয়া হয়নি। ২০১০ সালের পর এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে স্থলবন্দর ও ট্রানজিট রুটের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে নেপাল ও ভুটানের ট্রাক ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত পণ্য বহণ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর প্রবেশ করে মোংলা বা চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারে না৷
 
তবে অনেক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন এই রেল ট্রানজিট দেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকিও হতে পারে। যদি সঠিকভাবে এই যাতায়াতের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতে না থাকে। আবার ট্রানজিটের ইস্যু চীন কীভাবে দেখছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তাও বিবেচনার বিষয় বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন অনেকেই।

যদিও সরকার বলছে, ‘ডিজিটাল অংশীদারিত্ব’ এবং ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ‘সবুজ অংশীদারিত্ব’ বিষয়ক দুটি সমন্বিত রূপকল্পকে সামনে রেখে কাজ করতে বাংলাদেশ-ভারত সম্মত হয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে আরও চাঙা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এই ট্রানজিট সুবিধা।
 
তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চুক্তি বাস্তবায়নের পর তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, বন্দরগুলোর সুযোগ-সুবিধা ও সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি, ভারতের ভূমি ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশ ও তৃতীয় দেশের পণ্য আনা-নেয়ার সুযোগ সুবিধা আদায় করতে সরকারকে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি রেল ট্রানজিটে বাংলাদেশ যেন ন্যায্য মাশুল বা টোল পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।


মন্তব্য