শ্রীলঙ্কা থেকে অর্থনীতির শিক্ষা নেবে বাংলাদেশ?

দেউলিয়া
  © ফাইল ফটো

বছর দুয়েক আগে শ্রীলঙ্কাকে রাষ্ট্র হিসেবে দেউলিয়া ঘোষণা দেয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মনেও শঙ্কা জেগেছিল আশু অর্থনৈতিক পতন নিয়ে। অর্থনীতিতে করোনার পর থেকে হোঁচট খেয়ে আসলেও সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার হয়তো ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি দুবছর পর এসে অর্থনীতিতে না হলেও রাজনীতিতে শ্রীলঙ্কার রাজাপাকশে পরিবারের মতোই দশা হবে শেখ হাসিনা পরিবারের।

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে রোববার (৮ সেপ্টেম্বর)। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের টানা শাসনের সমাপ্তি ঘটে। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেখ হাসিনাই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি টানা এতদিন ক্ষমতায় ছিলেন এবং তিনিই দেশের প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী যাকে জনরোষ থেকে বাঁচতে শেষমেশ পালিয়ে যেতে হয়েছে।

২০২২ সালের জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুর দিকে শ্রীলঙ্কার সাধারণ নাগরিকদের চলমান আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা দেশটির রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করে এবং গোতাবায়ে পরিবারের পতন ঘটায়। শেষ মুহূর্তে জীবন বাঁচাতে দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়ে রাজাপাকশে সস্ত্রীক মালদ্বীপ পালিয়ে যান। মাত্র দুবছরের মাথায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রায় একই কায়দায় বোনকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে এবং দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণভবন দখল করেছিল সাধারণ জনতা। আন্দোলনকারীদের বড় একটি অংশের গণভবন দখল করার অনুপ্রেরণা এসেছে শ্রীলঙ্কা থেকে। অনেকেই সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি ভবন এবং বাংলাদেশের গণভবনের ছবি পাশাপাশি দিয়ে নিজেদের আন্দোলন সফল বলে পোস্ট করেছিলেন।

আন্দোলনের রাজনৈতিক এ বিজয়ের পাশাপাশি বর্তমানে এসে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দিক থেকেও শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বিশেষ করে তরুণ অর্থনীতিবিদদের মতে, যেসব কারণে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কারণগুলো বিদ্যমান। যদিও সংকট প্রকট আকার ধারণ না করায় দেউলিয়া হওয়ার পথে হাঁটতে হচ্ছে না বাংলাদেশকে। তবে এখন থেকে দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে পারলে আগামীতে সুবিধা পাওয়া যাবে।
 
জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের পিএইচডি গবেষক আনোয়ার হোসেন গালিব বলেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির রফতানি খাত সম্পূর্ণ পর্যটন নির্ভর। পর্যটনের বাইরে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আসে রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার উৎসও প্রায় একই ধাঁচের। রফতানির সিংহভাগ নির্ভরশীল পোশাকখাতের ওপর। বাকিটা রেমিট্যান্স এবং বিদেশি ঋণকেন্দ্রিক। এ অবস্থায় এ ধরনের একমুখী অর্থনৈতিক প্যাটার্ন থেকে বাংলাদেশ বের হতে না পারলে সরকার পরিবর্তন হলেও অর্থনৈতিক পরিবর্তন কঠিন হয়ে পড়বে।

আনোয়ার হোসেন গালিব বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক বিজয়, যেমনটা ছিল ১৯৭১ সালে স্বৈরাচার পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ জয়ের মতো। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে শুধু সরকারই পরিবর্তন হয়েছে, অর্থনৈতিক কাঠামোতে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। এতে করে ১৯৭২ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক পতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ, যার ফলাফল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। একটি বড় রাজনৈতিক বিজয়ের পর নতুন সরকারের কাছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে তুঙ্গে, যেমনটা এখন ইউনুস সরকারের প্রতি। এ অবস্থায় বহুদিন ধরে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে হলে শুধু আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ঋণের দিকে ঝুঁকলে হবে না, রফতানি খাতকে বহুমুখী করতে হবে।

অর্থনীতি এ গবেষক বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক বিপ্লব একমুখী। এতে করে সহজে লক্ষ্য স্থির রেখে উদ্দেশ্য সাধন করা যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক বিপ্লব বহুমুখী। দেশের রাজনৈতিক এ বিপ্লবের সফলতা নির্ভর করে আগামীর অর্থনৈতিক সংস্কারের সফলতার ওপর। এ সংস্কারের জন্য এখন থেকেই কাজ করতে হবে।

বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জের একটি মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, জুলাই মাসে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১.৬৬ শতাংশ। আগস্টে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ১০.৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে। চলতি বছরের শুরুতে দেশে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে কমেছে ২.৭৪ শতাংশ। আগস্টে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১.৩৬ শতাংশ। জুলাই মাসে যেটি ছিল ১৪.১০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি হ্রাসের এ হার বজায় থাকলে অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হবে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রফতানি আয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১২.৪০ শতাংশ ধরা হয়েছে। আগামীতে রফতানি আয় আগের থেকে কমবে না; বরং বেশি হবে। একই সঙ্গে রফতানি খাতের বহুমুখীকরণ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।

অন্যদিকে, এতদিন পোশাকখাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা আদৌ বলবৎ থাকবে কিনা এ নিয়ে নানা শঙ্কা থাকলেও অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে অবগত করা হয়েছে এবং তাদের থেকে ইতিবাচক আশ্বাসেরও আশা করা হচ্ছে।