সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ
প্রশংসায় ভাসছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা
- আনাস হক
- প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২২, ০২:২৩ PM , আপডেট: ১০ জুন ২০২২, ০৬:১৯ PM

চট্টগ্রামের কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে নার্সিং এটেনডেন্ট পদে কর্মরত মনিরুজ্জামান। সপ্তাহ আগে তার ঘর আলো করে এসেছে কন্যাসন্তান। তাই খুব শিগগিরই ছুটি নিয়ে সদ্যজাত সন্তানকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মীর। কিন্তু তার আগেই চির ছুটিতে চলে গেলেন তিনি। সদ্যজাত মেয়ের মুখ দেখা হলো না তার। শনিবার (৪ জুন) রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন মনিরুজ্জামান। তিনি কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোটের সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নাইয়ারা গ্রামের শামসুল হকের ছেলে।
শুধু মনিরুজ্জামান নয়, এই বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স-এর ১২ জন কর্মী নিখোঁজ ছিলেন। এরমধ্যে ৯ জনের মরদেহ পরবর্তীতে উদ্ধার করা হয়েছে, এরমধ্যে ৮ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। আরেকজনের মরদেহ উদ্ধার করা হলেও তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সোমবার (৬ জুন) বিকেলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া) শাহজাহান সিকদার বলেন, ফায়ার সার্ভিসের মোট ১২ জন সদস্য নিখোঁজ ছিলেন। এর মধ্যে নয়টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আটজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলেও পুড়ে অঙ্গার হওয়া একজনের নাম-পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারিনি আমরা।
তিনি আরও বলেন, উদ্ধার হওয়ার মরদেহগুলোর সঙ্গে তাদের ছবি মেলানো হচ্ছে। তবে চারজনের ছবি কোনো মরদেহের সঙ্গেই মিলছে না।
বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসের নিখোঁজ চার সদস্য হলেন ফায়ার ফাইটার রবিউল ইসলাম, ফরিদুজ্জামান, শফিউল ইসলাম ও লিডার মো. ইমরান হোসেন মজুমদার।
এদিকে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুল লাগার পর কেটে গেছে প্রায় ৪০ ঘণ্টা। সোমবার (৬ জুন) দুপুরে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনও নেভেনি আগুন। ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট ও সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানি আগুন নেভাতে কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময়েও আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ হিসেবে সেখানে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ থাকার বিষয়টি সামনে এসেছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মনির হোসেন বলেন, সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ দলের সহায়তায় কনটেইনারগুলো খুলে আগুন নেভানোর কাজ চলছে। আমরা এভাবে কাজ করতে পারলে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে আগুন নেভাতে পারব। ইতিমধ্যে আমরা কেমিক্যাল থাকা কয়েকটি কনটেইনার চিহ্নিত করেছি। সেগুলো অপসারণ করার প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি বলেন, এখন গার্মেন্টস আইটেমগুলো জ্বলছে। সেনাবাহিনীর লজিস্টিক ও এস্কেলেটর ব্যবহার করে আমরা একটা একটা করে কনটেইনার সরিয়ে আগুন নেভাব। সবগুলোতে একসঙ্গে পানি দিলে আগুন নিভবে না। কনটেইনার খুলে পানি দিতে হবে। আগুন নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করছে নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরাও।
জানা গেছে, শনিবার রাত ৮টার দিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোর লোডিং পয়েন্টের ভেতরে আগুনের সূত্রপাত হয়। কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। রাত পৌনে ১১টার দিকে এক কন্টেইনার থেকে অন্য কন্টেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। রাসায়নিক থাকায় বিকট শব্দে একটি কন্টেইনারে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, স্থানীয় শ্রমিকসহ অনেকে হতাহত হন।
এরপর লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনীসহ মোট ২৫টি ইউনিটের কয়েকশ ফায়ার সার্ভিসের কর্মী কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিকূল এই পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়ায় প্রশংসায় ভাসছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
লেখক ও শিক্ষক আমিনুল ইসলাম লিখেছেন, আমি সব সময় বিশ্বাস করে এসছি- বাংলাদেশের সরকারি কোন একটা অফিসের কর্মীরা যদি সৎ, স্বচ্ছ এবং কঠিন পরিশ্রমী হয়; সেটা বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। লেখালেখি'র জন্য আমি নিজে এই মানুষগুলো কিভাবে কাজ করে, তাদের সুবিধা-অসুবিধা বুঝার চেষ্টা করেছি। তাদের সাথে কথা বলেছি। তাদের ইন্টার্ভিউ নিয়েছি। তেমন কোন সুযোগ সুবিধাই নেই এদের। নেই কোন উন্নত যন্ত্রপাতি। স্রেফ নিজের জীবন বাজি রেখে এরা আমাদের বাঁচাতে ঝাপিয়ে পড়ে।
“গতকাল রাতের বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের অনেকেই মারা গিয়েছেন। অনেকেই হাসপাতালে এই মুহূর্তে মৃত্যু'র সাথে লড়ছেন। এমন অবস্থা হয়ত হত না। মালিক পক্ষ উনাদের কোন তথ্য দিয়ে সাহায্য করেনি। সেখানে যে বিস্ফোরক কেমিক্যাল আছে; সেটা তারা জানায়নি। আজ এখন অবদি মালিক পক্ষ একটা তথ্য দিয়েও সাহায্য করেনি। আমরা আমাদের ফায়ার ফাইটারদের হারালাম স্রেফ এই মালিকদের কারনে। কতটা অসহায় না হলে ফায়ার সার্ভিসের প্রধান বলতে পারেন- ‘আমাদের সত্যি'ই জানা নেই, এই আগুন কিভাবে নেভাতে হয়।’ এরপরও স্রেফ নিজেদের শরীরটা নিয়ে উনারা ঝাপিয়ে পড়েন, আমাদের বাঁচানোর জন্য।”
রাফিউল নামে এক সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, এই ইউনিফর্ম দেখলেই মন থেকে ভালোবাসা আসে। ধনী-গরীব নির্বিশেষে ছুটে যায় সামান্য একটি ফোন কলে, জীবন দিয়ে চেষ্টা চালায় মানুষের জান মাল নিরাপদ করতে। শহীদ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্যালুট। দুর্ঘটনায় আহত-নিহত সকলের প্রতি শোক এবং দোয়া।
জাহিদ মোল্লা নামে একজন লিখেছেন, ফায়ার ফাইটার্স! বাংলাদেশী ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের নিয়ে সব সময়ই বাজে কথা শোনা যায়। আমি অনেককে বলতে শুনেছি তারা বসে বসে বেতন পায়। কোথাও আগুন না লাগলে আরামসে মাস শেষে বেতন পেয়ে যায়। এর মতো শান্তির চাকরি আর হয় না।
“গতকাল সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোতে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৩ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০ জন। তাদের জীবন, তাদের পরিবার নিয়ে চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত থাকে তাদেরকে নিয়ে এসব কথা কি আসলেই মানায়! হ্যাঁ বাংলাদেশী ফায়ার ফাইটার্সদের সামর্থ্য হয়তো কম। আগুন নেভানোর প্রযুক্তিতে হয়তো তারা পিছিয়ে আছে। কিন্ত তাদের চেষ্টায় কোন কমতি দেখি না। প্রযুক্তির দায় অবশ্যই ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের না! জীবনের ঝুকি নিয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত সকল ফায়ার ফাইটার্সদের স্যালুট।”
আরিফুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন, অনেক বাহিনীকে দেখেছি কাজ করে বা না করে কৃতিত্ব নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিটা ঘটনায় দেখেছি ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করছেন।
“বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটা সদস্য আমার বীর মনে হয়। মনে হয়, অন্য অনেক বাহিনীর মতো আধুনিক যন্ত্রাপাতি বা পেশাদারিত্ব থেকে হয়তো তারা অনেক পিছিয়ে, কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটা সদস্য তাদের মমত্ববোধ নিয়ে, মানবপ্রেম নিয়ে, নিরলস চেষ্টা নিয়ে সবার থেকে এগিয়ে।”
ঘটনাস্থলে লক্ষীপুর ফায়ার সার্ভিস ইউনিটের সাজাদ (২৮) নামে এক কর্মী বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আমরা টানা ১৩ ঘণ্টা কাজ করছি। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আমরা ক্লান্ত হলেও আগুন ক্লান্ত হয়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কতক্ষণ সময় লাগবে বুঝতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, এখনও একের পর এক কনটেইনার বিস্ফোরণ হচ্ছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা। কনটেইনারে কোন জাতীয় রাসায়নিক রয়েছে তা জানা না যাওয়ায় নেভানো যাচ্ছে না আগুন। বর্তমানে আমরা লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনীসহ মোট ২৫টি ইউনিট কাজ করে যাচ্ছি।
এদিকে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ কর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া সেল) মো. শাহজাহান শিকদার জানান, ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন মহাপরিচালক। তিনি নিজে থেকে সার্বিক খোঁজ-খবর ও তদারকি করছেন। শোককে শক্তিতে পরিণত করতে ঢাকা থেকে সুদক্ষ ২০ জনের টিমকে তিনি দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের ২০ জনের বিশেষ হ্যাজম্যাট টিম চট্টগ্রামে যাচ্ছে। হ্যাজম্যাট (হ্যাজারডাস মেটারিয়াল) টিমে এসব সদস্য দেশে-বিদেশে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত।
মৃত ৮ জন
কুমিরা ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার মো. রানা মিয়া, নার্সিং এটেনডেন্ট মনিরুজ্জামান, ফায়ার ফাইটার আলাউদ্দিন, ফায়ার ফাইটার শাকিল তরফদার, লিডার মিঠু দেওয়ান, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ফায়ার ফাইটার রমজানুল ইসলাম, লিডার নিপন চাকমা।
নিখোঁজ ৪ জন
কুমিরা ফায়ার স্টেশনের লিডার ইমরান হোসেন মজুমদার, ফায়ার ফাইটার শফিউল ইসলাম, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার ফরিদুজ্জামান, ফায়ার ফাইটার মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স
প্রতিষ্ঠানটার পুরো নাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। বৃটিশ সরকার অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৯-৪০ অর্থ সালে ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টি করেন। বিভক্তিকালে আঞ্চলিক পর্যায়ে কলকাতা শহরের জন্য কলকাতা ফায়ার সার্ভিস এবং অবিভক্ত বাংলায় বাংলার জন্য বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টি করেন।
১৯৪৭ সনে এ অঞ্চলের ফায়ার সার্ভিসকে পূর্ব পাকিস্তান ফায়ার সার্ভিস নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৫১ সনে আইনী প্রক্রিয়ায় সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সৃজিত হয়। ১৯৮২ সালে ফায়ার সার্ভিস পরিদপ্তর, সিভিল ডিফেন্স পরিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের উদ্ধার পরিদপ্তর-এই তিনটি পরিদপ্তরের সমন্বয়ে বর্তমান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরটি গঠিত হয়।