প্রশংসায় ভাসছে জাতীয় বীর ফায়ার ফাইটারেরা

যৎসামান্য বেতনে পর্বতসম ঝুঁকি

ফায়ার সার্ভিস
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রধান কার্যালয়ে সীতাকুণ্ডে নিহত ফায়ারম্যানদের শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়।  © দ্য বাংলাদেশ মোমেন্টস

প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট যে কোন দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রথমেই দেখা মেলে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা করে যান ফায়ার ফাইটাররা। সবশেষ সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণেও অদম্য সাহস ও নিঃশর্ত আত্মত্যাগের অমোচনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ফাইটাররা। সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন সংস্থাটির ১২ জন সদস্য যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। 

সবচেয়ে বেশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। অথচ অন্যান্য বাহিনীর তুলনায় সুযোগ-সুবিধা একেবারেই কম। নিয়োগ বিধির তথ্য অনুসারে, জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে একজন লিডার গ্রেড-১৬ এ মূল বেতন ৯৩০০ হাজার থেকে ২২ হাজার ৮৯০ টাকা পর্যন্ত। আর ফায়ারফাইটার ও নার্সিং এ্যাটেনডেন্ট চাকরির গ্রেড-১৭। যা বেতন কাঠামোতে ৯ হাজার টাকা থেকে ২১ হাজার ৮০০ টাকা পযর্ন্ত।

ফায়ার ফাইটারদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

অগ্নিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী- ছবি: © দ্য বাংলাদেশ মোমেন্টস।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক ফায়ারম্যান জানান, ঘটনার যেকোন সময় দেয়াল ধসে পড়তে পারে, আগুনে পুড়ে মারা যেতে পারি- এমন ঝুঁকি সব সময়ই থাকে। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অপারেশনে যায়। আমরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি অথচ ফায়ারম্যানদের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। এছাড়া আমাদের জীবনের নিরাপত্তা কে দেবে? 

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার মো. মাইন উদ্দিন বলেছেন, অগ্নি নির্বাপণে প্রশিক্ষিত ফায়ার ফাইটাররা ছিল। ক্যামিকেলের থাকা তথ্য না থাকায় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে। কারণ আমরা মালিক পক্ষের কাউকে পাইনি যারা আমাদের এ বিষয়ে ইনফর্ম করবেন।

জানাজা শেষে গণমাধ্যমে কথা বলছেন ফায়ারের ডিজি

জানাযা শেষে কথা বলছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ডিজি-ছবি: © দ্য বাংলাদেশ মোমেন্টস।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ঘটনায়ও যদি রাসায়নিকের আগুন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো, তাহলে এ ধরনের ঘটনা মোকাবিলায় করতে গিয়ে এত মানুষের প্রাণহানি ঘটত না। অথচ নিরূপায় হয়ে সাধারণ পানি দিয়েই রাসায়নিকের আগুন নেভানো যাবে না জেনেও ফায়ার ফাইটাররা অন্যের জীবন রক্ষায় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুনের মোকাবিলা করছেন।  

দীর্ঘ ৩৯ বছর বড় বড় দুর্ঘটনায় আগুন নেভানোর দায়িত্ব পালন করা ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগে বিভিন্ন অভিযানে একজন সদস্য মারা যাওয়ার ইতিহাস আছে ৷ তবে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনজন নিহতের একটি ঘটনা আছে ৷ একদিনে এতো ফায়ারম্যানের মৃত্যু তিনি কখনও দেখেননি ৷ তিনি আরও জানান, ১৯৮১ সাল থেকে এই পর্যন্ত মোট ১৭ জন ফায়ার সার্ভিস সদস্য নিহত হয়েছেন ৷ আর এই ঘটনায় ১২ কর্মীকে হারালো ফায়ার সার্ভিস।

দেশজুড়ে প্রশংসা পেয়েছেন ফায়ারম্যানরা: বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুল লাগার পর  টানা তিনদিন কাজ করেছে ফায়ারম্যানরা। জীবন দিয়েছেন ১২ জন বীর ফায়ারম্যান। ফায়ার সার্ভিসের ২৫ টি ইউনিট ও সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানি আগুন নেভাতে কাজ করেছে। 

রাফিউল নামে এক সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, এই ইউনিফর্ম দেখলেই মন থেকে ভালোবাসা আসে। ধনী-গরীব নির্বিশেষে ছুটে যায় সামান্য একটি ফোন কলে, জীবন দিয়ে চেষ্টা চালায় মানুষের জান মাল নিরাপদ করতে। শহীদ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্যালুট। দুর্ঘটনায় আহত-নিহত সকলের প্রতি শোক এবং দোয়া।

জাহিদ মোল্লা নামে একজন লিখেছেন, ফায়ার ফাইটার্স! বাংলাদেশী ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের নিয়ে সব সময়ই বাজে কথা শোনা যায়। আমি অনেককে বলতে শুনেছি তারা বসে বসে বেতন পায়। কোথাও আগুন না লাগলে আরামসে মাস শেষে বেতন পেয়ে যায়। এর মতো শান্তির চাকরি আর হয় না।  

তিনি আরও লিখেছেন, সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোতে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০ জন। তাদের জীবন, তাদের পরিবার নিয়ে চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত থাকে তাদেরকে নিয়ে এসব কথা কি আসলেই মানায়! হ্যাঁ বাংলাদেশী ফায়ার ফাইটার্সদের সামর্থ্য হয়তো কম। আগুন নেভানোর প্রযুক্তিতে হয়তো তারা পিছিয়ে আছে। কিন্ত তাদের চেষ্টায় কোন কমতি দেখি না। প্রযুক্তির দায় অবশ্যই ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের না! জীবনের ঝুকি নিয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত সকল ফায়ার ফাইটার্সদের স্যালুট।

আরিফুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন, অনেক বা‌হিনী‌কে দে‌খে‌ছি কাজ ক‌রে বা না ক‌রে কৃ‌তিত্ব নি‌য়ে‌ছেন। কিন্তু প্র‌তিটা ঘটনায় দে‌খে‌ছি ফায়ার সা‌র্ভিসের সদস্যরা জীব‌নের ঝুঁ‌কি নি‌য়ে নিরলসভা‌বে কাজ কর‌ছেন। বাংলা‌দে‌শের ফায়ার সা‌র্ভি‌সের প্রতিটা সদস্য আমার বীর ম‌নে হয়। ম‌নে হয়, অন্য অনেক বা‌হিনীর ম‌তো আধু‌নিক যন্ত্রাপা‌তি বা পেশাদা‌রিত্ব থে‌কে হয়তো তারা অনেক পি‌ছি‌য়ে, কিন্তু ফায়ার সা‌র্ভি‌সের প্রতিটা সদস্য তা‌দের মমত্ববোধ নিয়ে, মানব‌প্রেম নি‌য়ে, নিরলস চেষ্টা নি‌য়ে সবার থে‌কে এগি‌য়ে।

সদ্যজাত সন্তানের মুখ দেখা হলো না ফায়ারম্যানের: চট্টগ্রামের কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে নার্সিং এটেনডেন্ট পদে কর্মরত মনিরুজ্জামান। সপ্তাহ আগে তার ঘর আলো করে এসেছে কন্যাসন্তান। তাই খুব শিগগিরই ছুটি নিয়ে সদ্যজাত সন্তানকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মীর। কিন্তু তার আগেই চির ছুটিতে চলে গেলেন তিনি। সদ্যজাত মেয়ের মুখ দেখা হলো না তার। শনিবার (৪ জুন) রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন মনিরুজ্জামান। তিনি কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোটের সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নাইয়ারা গ্রামের শামসুল হকের ছেলে।

যারা প্রাণ হারালেন:  কুমিরা ফায়ার স্টেশনের লিডার ইমরান হোসেন মজুমদার, ফায়ার ফাইটার শফিউল ইসলাম, ফায়ার ফাইটার মো. রানা মিয়া, নার্সিং এটেনডেন্ট মনিরুজ্জামান, ফায়ার ফাইটার আলাউদ্দিন, ফায়ার ফাইটার শাকিল তরফদার, লিডার মিঠু দেওয়ান। এছাড়া সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী,ফায়ার ফাইটার রমজানুল ইসলাম, লিডার নিপন চাকমা, ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার ফরিদুজ্জামান, ফায়ার ফাইটার মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম।

অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের জন্য দোয়া করছেন সহকর্মীরা

ফায়ার সার্ভিসের নিহতদের জন্য দোয়া করছেন সহকর্মীরা- ছবি: © দ্য বাংলাদেশ মোমেন্টস।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স: প্রতিষ্ঠানটার পুরো নাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। বৃটিশ সরকার অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৯-৪০ অর্থ সালে ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টি করেন। বিভক্তিকালে আঞ্চলিক পর্যায়ে কলকাতা শহরের জন্য কলকাতা ফায়ার সার্ভিস এবং অবিভক্ত বাংলায় বাংলার জন্য বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টি করেন।

১৯৪৭ সনে এ অঞ্চলের ফায়ার সার্ভিসকে পূর্ব পাকিস্তান ফায়ার সার্ভিস নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৫১ সনে আইনী প্রক্রিয়ায় সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সৃজিত হয়। ১৯৮২ সালে ফায়ার সার্ভিস পরিদপ্তর, সিভিল ডিফেন্স পরিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের উদ্ধার পরিদপ্তর-এই তিনটি পরিদপ্তরের সমন্বয়ে বর্তমান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরটি গঠিত হয়।