আত্মহত্যা নয় আত্মপ্রত্যয়ী হোন

ক্যাম্পাস
আত্মহত্যা নয় আত্মপ্রত্যয়ী হোন  © টিবিএম ফটো

শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। আত্মশক্তি মানুষের মাঝে সুপ্ত অবস্থায় থাকে বলে অনেকক্ষেত্রেই মানুষ নিজের শক্তিকে বুঝতে পারে না। শিক্ষা সে সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। যেমনটা জলন্ত কয়লা বাতাসের অভাবে কালো রূপ ধারণ করে বলে মনে হয় কয়লার  তেজস্ক্রিয়তা হারিয়ে গেছে; না, কয়লা তার পুড়ানোর ক্ষমতা হারায়নি, কামার ঐ কয়লার গায়ে বাতাস দিলেই দ্বিগুণ তেজে খা খা করে জ্বলে উঠবে।

আপনি সে কামার, আপনার সুপ্ত প্রতিভা  জলন্ত কয়লা, শিক্ষা সে বাতাস আর আপনার  সুপ্ত প্রতিভা কালো আস্তরণে ঢাকা কয়লার মতো পড়ে আছে; তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঘটানোর তীব্র ইচ্ছাই আত্মশক্তি। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘সুচিন্তা’  নামক গ্রন্থের ‘আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা’ প্রবন্ধের আলোকে বলবো, “সিংহ শাবক যে ভেড়া না হইয়া সর্বদাই সিংহ হয়, সে তাহার বিশ্বাসের গুণেই। আর মেষ শাবক যে সিংহ শাবক না হইয়া মেষ হয় সেও তাহার বিশ্বাসের গুণে।”

‘আত্মশক্তি’ মানেই নিজস্ব ক্ষমতা, ’আত্মবিশ্বাস’ মানেই নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস। আত্মশক্তি অর্জন মানেই, নিজস্ব ক্ষমতা অর্জন, সংরক্ষণ এবং এ ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করা। Education means change the behavior of human nature. শিক্ষা মানুষের আচরণের প্রকৃতিকে পাল্টে দেয়। যেখানে তারা হবে পরিবর্তিত আলোর মশাল সেখানে শিক্ষিত এ প্রজন্ম কেন সুইসাইডাল হয়ে উঠছে তা গভীর ভাবনার সৃষ্টি করে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেড়েছে আত্মহত্যা। অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষার্থী  একই সপ্তাহের ব্যবধানে আত্মহত্যা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো সামনে আসছে। যাদের হওয়ার কথা ছিল আত্মপ্রত্যয়ী তারা কেন হয়ে যাচ্ছে আত্মহত্যা প্রবণ ? আত্মহত্যার মহামারি কেন ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীদের মাঝে? অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যার সংখ্যা দাঁড়ায় ৯ জন। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংখ্যাটি ৬ জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ জন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন। প্রায় ৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে এ তথ্য প্রকাশ করেছে সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে,  দেশে ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ৫৩২ জন, ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও ২০২০ সালে ৭৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অর্থ্যাৎ প্রতি বছরই এ সংখ্যাটি বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখ মানুষে কমপক্ষে ৭ দশমিক ৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৬ জন। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। 

suicide, or ending ones own life, is a tragic event with strong emotional repercussions for its survivors and for families of its victims. It is the act of intentionally causing ones own death. এলার্মিং হারে বাড়ছে আত্মহত্যা ! আত্মহত্যার প্রবণতাকে যে জয় করতে পারে সেই জয়ী। স্বপ্ন পুরণে ব্যর্থ হয়ে বেদনায় কাতরাচ্ছেন! আপনি ভুলে যাবেন না বেদনা থেকে যে আনন্দের উৎপত্তি সে আনন্দের কোন তুলনা নেই। বিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবালের একটি উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য ; জীবন দর্শনের নিগূঢ় অর্থ আত্মপ্রতিষ্ঠা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ। ব্যক্তিত্বের অভাবই মৃত্যু। বিখ্যাত দার্শনিক বোভি তার দর্শন দৃষ্টিতে বলেন, “ যখন সব কিছু হারিয়ে যায় ভবিষ্যত তখনও থাকে।”

একটা বাস্তব উদাহরণ এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। ৯ জন পাইলট নিয়োগ দিবে সরকার, স্বপ্ন ছিলো তার আকাশে উড়ার পাখি হয়ে নয়, পাইলট হয়ে। পরীক্ষার ফলাফল তার স্বপ্নই কেড়ে নেয়নি থাবা দিয়েছিল তার জীবন কেড়ে নেয়ার জন্যও। মেরিট পজিশন ১১তম, পাইলট হবে ৯ জন। অর্ধলক্ষাধিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পিছনে হটিয়ে ১১ তম পজিশন করলেও তার আকাশে উড়ার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। গরিবের ছেলে অন্য কোন উপায়ে মেরিট পজিশন ৯ এর ভিতরে আনারও ক্ষমতা নেই। পাছে প্রতিবেশীদের কটূক্তির বিষাদ স্বাদ নেয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা।

পথ একটাই খোলা, তার দিকে হাতছানি দিচ্ছে যমদূত, যে পথ জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়ার পথ। মাকে তার পরীক্ষার ফলাফল না জানিয়ে নিজেকেই ফলাফল হিসেবে তার নিথর দেহ দেয়ার পণ করে ফেলল। লিখতে বসবে তার অস্বাভাবিক ফলাফল মাকে দেয়ার কারণ। হাতে কলম, অপেক্ষায় নিজ তৈরি মৃত্যু কূপ,শয়তানের শয়তানি পলিসি কিছুক্ষণ পর এক্সিকিউট হবে, ঝুলে পড়বে তার নিথর দেহ আর অট্টহাসিতে মেতে উঠবে শয়তান। এ দৃশ্য দেখার অপেক্ষা আর শয়তান মেনে নিতে পারছে না। তাই চলছে বিবেক আর শয়তানের লড়াই। 

মৃত্যু সনদ লেখার খাঁতা খুঁজতে গিয়ে খুজে পেল জীবন! তার নিজ হাতে মৃত্যু সনদ লিখে পরোয়ানা জারি করার আগেই চোখে পড়ল মহা মূল্যবান এক কবিতা যা তাকে মৃত্যুর দ্বার থেকে টেনে জীবন সাগরের তীরে তুলল, হাতছানি দিচ্ছে কবিতার পঙক্তিগুলো নতুন জীবনের দিকে, আর মৃত্যু কূপ হাতছানি দিচ্ছে নতুন জগতের, যা ভিন্ন জগৎ, ভয়ঙ্কর সে জগৎ। জীবন মরণ সন্ধিক্ষনে লাইনগুলো তার বিবেকের স্নায়ুতন্ত্রে নাড়া দিচ্ছিল। যখন বিবেকের জয় হয় তখন মানবতার নতুন জীবন খুঁজে পায়।

কি এমন কবিতা! যা শয়তানের পলিসির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে! কবিতাটির পঙক্তিগুলি ছিল-

“আমি সম্ভাবনা নিয়ে জন্মেছি,
আমি জন্মেছি মঙ্গল আর বিশ্বাস নিয়ে
আমি এসেছি স্বপ্ন  নিয়ে
মহৎ লক্ষ্য নিয়েই আমার জন্ম
আসি ডানা নিয়ে জন্মেছি, হামাগুড়ির জীবন আমার জন্য নয়। আমি উড়বো, আমি উড়বো, আমি উড়বোই"
....... মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি।

ছেলেটি প্রতিজ্ঞা করলো, হ্যা আমি উড়বোই। I have to be someone great. সেই থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জালালুদ্দিন রুমি ছিলেন হারতে বসা বালকটির গুরু। হারতে বসা বালকটিই হয়েছিল পরবর্তীতে সফলদের শিরোমণি, ভারতের মিসাইল ম্যান ও সফল রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম। যিনি অনুপ্রেরণা মুলক কথার জন্য বিখ্যাত। যে অমর উক্তি গুলো তাকে অমর করে রেখেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, “স্বপ্ন সেটা নয় যে তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটা যা পূরণের প্রত্যাশা তোমাকে ঘুমাতে দেয়না।”

যদি তুমি তোমার কাজকে স্যালুট করো তাহলে দেখবে তোমাকে আর কখনও কাউকে স্যালুট করতে হবে না, বরং তোমাকেই মানুষ স্যালুট করবে। আর যদি কাজে ফাঁকি দাও তাহলে তোমাকেই সবাইকে স্যালুট করতে হবে।যারা হৃদয় দিয়ে কাজ করতে জানেনা তাদের অর্জন অন্তঃসারশূন্য। প্রতিদিন পাচটি লাইন বলো ১.  আমি সেরা ২. আমি করতে পারি ৩. আল্লাহ সব সময় আমার সাথে আছেন ৪. আজ দিনটা আমার  ৫. আমি জয়ী। 

অনুপ্রেরণা দেয়া এই এ পি জে আব্দুল কালাম তিনিও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন  অন্যের নিকট। পারস্যের কবি জালালুদ্দিন রুমি ছিলেন তার স্বপ্নের সারথি; যে এক কালামকে দাঁড় করিয়েছে আর ওই বালক কালামই এখন কোটি জনতার স্বপ্নের সারথি, অন্যের অনুপ্রেরণার মশাল। পূরণ হয়েছিল মায়ের স্বপ্ন। পাইলট হতে পারেননি, হয়েছিলেন তাদের দিকনির্দেশক ও দেশের কাণ্ডারী।
সুতরাং, নতুন প্রজন্মের জন্য বার্তা এটাই, আত্মাকে হত্যা নয় বরং আত্মহত্যার প্রবণতাকে হত্যা করুন। 

আত্মহননের পথ যে খুঁজে নিয়েছে  হয়তো তার নিকট ওই বালক কালামের মতো কোন দৈব দূত এসে আশার বাণী শুনায়নি এবং সুইসাইড নোট করার সময় পাননি, ওরকম কোন কবিতার পঙক্তি যা আরেক কালামের জন্ম দিত। পরিবারকেই হতে হবে তার সন্তানের সূরক্ষার দূর্গ। সন্তানের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল পরিবার। যখন সেখানেও ঠাঁই না হয় তখন তার অস্তিত্ব হারাতে থাকে জীবন সমুদ্রের অতল গহ্বরে। অসহ্য যন্ত্রণা লাঘবের জন্য সে খুঁজে নেয় মৃত্যু নামক সুধা। ধরাকে বিদায় জানিয়ে নিষ্ঠুর পৃথিবীর লোকগুলিকে মুক্তি দিতে সে পাড়ি দেয় অজানা পথে, সে পথ যে মসৃণ নয়। মৃত্যুর মাধ্যমে এ পৃথিবীর অসহ নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে যে পথ সে বেছে নেয় তা যে যন্ত্রণার শেষ নয় বরং শুরু। 

প্রত্যেক ধর্মেই আত্মহত্যা মহা পাপ। এদের ক্ষমা নেই। অনন্তকাল নরক যন্ত্রণা ভোগ করার হুঁশিয়ারি রয়েছে এদের জন্য। পৃথিবীর যন্ত্রণা সময়ের সাথে সাথে লঘু হয়, এক সময় তার আর বেদনার রেশ থাকে না অন্তরে, কিন্তু পরকালের যন্ত্রণা!  সে তো লাঘবের নয় বরং ক্রমবর্ধমান। প্রকৃতপক্ষে যে হৃদয় জানে তার ভাল মন্দ তথা রিজিকের ফায়সালা হয় আসমানে সে হৃদয় ক্লান্ত হতে পারেনা; এমনকি বিচলিত হতে পারেনা। আত্মহত্যা সে তো অসম্ভব। এরপরেও যাদের অভিমানে সে নিজেকে শেষ করার পণ করেছিল তারাও আমৃত্যু বিবেকের কারাগারে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে; পরিবার তখন হয়ে যায় দিশেহারা; অভিমানের অনলে হয়ে যায় ছাই। তাই পরিবারকে হতে হবে সন্তানের সুরক্ষার দূর্গ, বুঝতে হবে তার প্রয়োজন ও প্রত্যাশা।

- মাহাবুব আলম

সাবেক শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ