ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর লাশ উদ্ধার— হত্যা নাকি আত্মহত্যা

মানববন্ধন
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে মানববন্ধন  © টিবিএম ফটো

রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে সানজনা মোসাদ্দিকা নামে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি ইংরেজি বিভাগের সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। গতকাল শনিবার দুপুরে ১২ তলা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হন সানজনা। পরে তাকে উদ্ধার করে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। এ সময় চিকিৎসকেরা সানজনাকে মৃত ঘোষণা করেন। সন্ধ্যার পর পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে দক্ষিণখান থানায় নিয়ে যায়। 

তবে বন্ধুদের দাবি, সানজনাকে হত্যা করা হতে পারে। তারা বলছেন, তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন—এমন খবর জানার পর ঝামেলা তৈরি হয়। তার অকালপ্রয়াণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সহপাঠীদের মধ্যে। আজ রবিবার দুপুরে এ ঘটনার বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে মানববন্ধন করেছেন সানজনার সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এ ঘটনার পর থানায় ওই ছাত্রীর লাশ দেখতে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভাষ্য, লাশ দেখার পর তাদের এ ঘটনাটি সুইসাইডের কোনো লক্ষণ মনে হয়নি। ১২ তালা থেকে লাফ দিলে দেহটি তো থেতলে যাওয়ার কথা! মুখ নীল হয়ে যাওয়ার কথা! হয়নি এসব কিছু। দেখে মনে হয়েছে সে ঘুমাচ্ছে। এসময় তাদের মৃতদেহটিও ছুয়ে দেখতে দেওয়া হয়নি। 

অর্নি নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠীর জানান, থানায় কোনোভাবেই এটি সুইসাইড মনি হয়নি! একটা মেয়ে ১২ তালার উপর থেকে লাফ দিলে বডির শুধু একটা হাড় ভাঙ্গবে? বডি তো থেতলায় যাওয়ার কথা! ইন্টার্নাল ব্লিডিংয়ে মুখ নীল হয়ে যাওয়ার কথা! হয়নি এসব, দেখে শুধু মনে হয়েছে সে ঘুমাচ্ছে। আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দড়ি দিয়ে বেধে মারধরের চিহ্নগুলো। আর সবচেয়ে আজব লাগলো যে, ঘটনার পর ওর বাবা গায়েব।

থানায় ওই ছাত্রীর লাশ দেখতে যাওয়া আতকিয়া মাইশা নামে আরেক ছাত্রী জানান, থানায় গিয়ে ওর লাশ শেষ বারের মত ধরতে চাইলেও আমাকে ধরতে দেয়া হয়নি। ছবি দেখিয়েছে। কিন্তু ছবি দেখে আমি এতটুকু নিশ্চিত হয়েছি, সানজনা সুইসাইড করে নি। তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তাকে।

তিনি আরও বলেন, দুপুর ১টা দিকের ঘটনা। তখনও সানজনা জীবিত ছিল। পরবর্তীতে হাসপাতালে নিয়ে গেলে দুটি ইনজেকশন দেয়ার পর সানজনা মৃত্যুবরণ করে। পরে আরেকটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে ৩টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করে। পরো শরীরে মারধরের দাগ, একটি পা ভাঙ্গা এবং কোমরের হাড্ডি ভাঙ্গা। মানুষ এতো নির্মম কিভাবে হতে পারে? 

পরিবারের বরাত দিয়ে দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রহমান বলেন, জেনেছি যে, শনিবার দুপুরের দিকে দক্ষিণখানের একটি বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন সানজনা নামের ওই শিক্ষার্থী। এতে গুরুতর আহত হলে তাঁকে উদ্ধার করে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে যান পরিবারের সদস্যেরা। পরে চিকিৎসকেরা সানজনাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর সন্ধ্যায় পুলিশ হাসপাতাল থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে। ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা হয়েছে।

ওসি মামুনুর বলেন, পরিবার জানিয়েছে, সানজনার বাবা গাড়ি ভাড়া দেওয়ার (রেন্ট–এ কার) ব্যবসা করেন। পরিবারের ভরণপোষণ দিতে হিমশিম খাওয়ায় স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হতো তাঁর। মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচও চালাতে পারছিলেন না তিনি। কোনো কারণে বাবার প্রতি রাগ–ক্ষোভ থেকে সানজনা আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ওসি আরও বলেন, তবে নিহত সানজনার বন্ধু-বান্ধব ভিন্ন কথা বলছেন। তারা বলছেন, সানজনার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন—এমন খবর জানার পর ঝামেলা তৈরি হয়। বন্ধুদের দাবি, সানজনাকে হত্যা করা হতে পারে। আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। কোনটা সত্য, তা বের হয়ে আসবে।

সুইসাইড নোটে কী লেখা ছিল জানতে চাইলে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ও এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা রেজিয়া খাতুন বলেন, ওই সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, আমার মৃত্যুর জন্য আমার বাবা দায়ী। একটা ঘরে পশুর সাথে থাকা যায়, কিন্তু অমানুষের সাথে না। একজন অত্যাচারী এবং রেপিস্ট যে কাজের মেয়েকেও ছাড়ে নাই। আমি তার করুণ ভাগ্যের সূচনা।

রেজিয়া খাতুন বলেন, সানজনার বাবার নাম শাহিন ইসলাম। তাকে আসামি করে শনিবার দিবাগত রাতে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে একটি মামলা করেছেন তার স্ত্রী উম্মে সালমা মনি। যদিও তিনি শুরুতে অভিযোগ করতে চাননি। তবে, মেয়ের খালা উম্মে কুলসুম মামলা করতে চান। একপর্যায়ে সালমা মামলা করতে রাজি হন।

ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে, এমন প্রশ্নে রেজিয়া খাতুন দাবি করেন, প্রায় এক বছর আগে শাহিন ইসলাম দ্বিতীয় বিয়ে করেন। শুনেছি নতুন স্ত্রী ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বেশ কিছুদিন আগে এ খবর মেয়ে জেনে যায়। এরপর থেকেই মূলত তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। মেয়েকে মারধর করা হতো নিয়মিত। যদিও শাহিন ইসলামের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে মাঝেমধ্যে তাদের পরিবারে কলহ চলতো। সর্বশেষ কয়েকদিন ধরে সানজনা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার খরচের জন্য এক লাখ ২৪ হাজার টাকা চাচ্ছিলেন। গতকালও এ টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু, শাহিন ইসলাম টাকা না দিয়ে মারধর করেন। এরপরই এ ঘটনা ঘটেছে।

এসআই রেজিয়া খাতুন আরও বলেন, মেয়ের খালা উম্মে কুলসুম আমাকে বলেছেন, শাহিনের স্বভাব ভালো ছিল না। বাসায় কাজের মেয়ে রাখতেও ভয় পেতেন তার স্ত্রী। এ ঘটনার পর থেকে শাহিন পলাতক। তাকে ধরার চেষ্টা করছি আমরা।


মন্তব্য