২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:১৪

কুষ্টিয়ায় প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ফাঁদ, অবৈধ ক্লিনিক বন্ধে দায় নিচ্ছে না কেউ

  © মোমেন্টস ফটো

কুষ্টিয়ায় ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা ক্লিনিক গুলো যেন মৃত্যু ফাঁদ হয়ে ওঠেছে। চিকিৎসা সেবা কে কেবলমাত্র মুনাফা আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে এ জেলার অধিকাংশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল। চিকিৎসার নামে জীবনহানি নিত্যদিনের ঘটনা হলেও এর দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদানের ঘটনা শূন্যের কোঠায়।একের পর মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এসব ক্লিনিক বন্ধে দায় নিচ্ছে না কেউ। 

কুষ্টিয়া সদর উপজেলা মোড়ে অবস্হিত ইসলামিয়া হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে সন্তানসহ আবারো প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।অস্বাভাবিক মৃত্যু হলেও কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ছাড়পত্রে মৃত্যুর কারন উল্লেখ করা হয় নি। রহস্য জনক কারনে হাসপাতালে দায়িত্বরত আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। ক্লিনিক মালিক নিজামের স্ত্রী কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের স্টাফ নার্স পদে চাকুরী করার সুবাদে বিষয়টি আইনের আওতায় আসে নি বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

নিহত প্রসূতি হলেন খুলনার নিউমার্কেট এলাকার জহুরুল ইসলামের স্ত্রী রিমা খাতুন (৩০)সহ নবজাতক শিশু।তাঁরা কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার ভাদালিয়ার স্বস্তিপুরে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।

জানা যায়,শুক্রবার (৩০ ডিসেম্বর) রিমার প্রসব বেদনা উঠলে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইসলামিয়া হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করান তাঁর (রিমা) স্বামী জহুরুল ইসলাম।ভর্তির পরে আল্ট্রাসনো করে চিকিৎসক জানান গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা গেছে।নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমেই বাচ্চা প্রসব করানো যাবে।একজন ২ বার দু'টি ট্যাবলেট ঔষধ খাওয়ায়।এরপর থেকেই শুরু হয় প্রচন্ড পেট ব্যথা।ব্যথার যন্ত্রণা নিয়ে সারারাত অতিক্রান্ত হলেও সেখানকার কোনো চিকিৎসক, নার্স বা আয়াও আসেনি রোগীর কাছে।শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) সকাল ৭ টার দিকে রোগীর স্বজনের চাপে একজন আয়া এসে রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে মৃত সন্তান প্রসব করায়।মৃত সন্তানের চোয়াল কাটা ছিলো।এসময় ওই আয়ার সাথে শুধুমাত্র একটা বাচ্চা ছাড়া আর কেউ ছিলো না।নরমাল ডেলিভারি করানোর সময় ওই আয়া প্রসূতি মায়ের টিয়ার ছিড়ে ফেলে।ফলে শুরু হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।এমতাবস্থায় কোনো চিকিৎসক না থাকায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ওই প্রসূতি মা।তখন তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল মালিকের স্ত্রী পারভীন এসে ক্ষতস্থানে সেলাই দিয়ে দ্রুততর সময়ে মৃত অবস্থায় রিমাকে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।

২০২০ সালের ০১আগস্ট বিকেলে কুমারখালী উপজেলার বাঁশগ্রামের বাসিন্দা চালকল শ্রমিক আকবর আলীর সন্তান সম্ভবা প্রসুতি স্ত্রী তানিয়া খাতুন(২২)র প্রসব ব্যাথা উঠলে কুষ্টিয়া ইসলামিয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়। সে রাতে অঞ্জান ডাক্তার ছাড়াই সিজার করে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। এরপর ঞ্জান ফেরেনি তানিয়া খাতুনের। এ ঘটনায় মামলা করে তানিয়ার স্বামী। মামলার চার্জ গঠন হলেও বিচার প্রক্রিয়া হাইকোর্টে স্থগিত করে রেখেছে ক্লিনিক মালিক মশিউর রহমান নিজাম। 

আরও পড়ুন: চসিক সার্ভার হ্যাক করে জন্ম সনদের ব্যবসা, গ্রেপ্তার ৪

চিকিৎসা অবহেলা জনিত মৃত্যুর ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বজনদের দেয়া অভিযোগের সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়,২মার্চ ২০২২ মঙ্গলবার দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের পিয়ারপুর গ্রামের ফারুক হোসেনের গর্ভবতী স্ত্রী নাসিমা খাতুনের (২৬) প্রসববেদনা ওঠে। প্রসববেদনায় বিকেলে তাকে ভেড়ামারা শহরের মধ্য বাজারের সাদিয়া ক্লিনিকে তাকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে বিকেল ৫টায় তাঁর একটি সুস্থ কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এরপর প্রসূতির অনেক বেশি রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে পথিমধ্যে প্রসূতির মৃত্যু হয়।

২০২১ সালের ২০ অক্টোবর কুষ্টিয়া ইবি থানার সেবা ক্লিনিকে সিজার করে এক প্রসূতি নারীর মৃত্যু হয়েছে। ১৮ অক্টোবর আব্দালপুর ইউনিয়নের বিষনুদিয়া গ্রামের মাহাবুল এর স্ত্রী তুলিকা বেগম( ২৬) এর প্রসব বেদনা উঠলে তাকে হরিনারায়নপুর ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। বিকেল ৫টায় সিজারের মাধ্যমে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেয়।এরপরই প্রসূতি মায়ের অবস্হা খারাপ হতে থাকে।উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিক্যালে নিয়ে জানা যায় তার নাড়ী কেটে ফেলা হয়েছে।

২০২১ সালের ৯জুন সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া সনো হসপিটালে নাসরিন নাহার রিপা(৩০) নামের এক প্রসূতিকে ভর্তি করা হয়। ঐ দিনই রাত ১২টার সময় ডাঃ নাজনীন আক্তার জাহানের সিজারের মাধ্যমে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ১২ তারিখ প্রসূতির জ্বর ও পেট ব্যথা থাকা অবস্থায় এক প্রকার জোর করেই সনো হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেয়া হয়। বাড়ী এসে জ্বর বাড়তে থাকলে ১৩ তারিখ দুপুরে রোগী কে সনো হসপিটালে নিয়ে গেলে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহানের সাথে যোগাযোগ শেষে প্রসূতিকে ভর্তি নেয়। এসময় অবস্থা খারাপ হতে হতে প্রসূতির দেহ নিথর হয়ে যায় ।

২০২০ সালের ৯ নভেম্বর সকাল ৯টায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আল্লার দর্গা বাজারের বিশ্বাস কিনিকে ভূল সিজার অপারেশনে প্রসূতি রমনী খাতুন(২০)সহ গর্ভজাত শিশুটিরও মৃত্যু হয়। হোগলবাড়ীয়া ইউনিয়নের বাচ্চু আলীর স্ত্রী রমনী খাতুন কে অতিরিক্ত এনেস্থিসিয়া প্রয়োগের ফলে মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। 
২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার কুমারখালি উপজেলার সোন্দহ গ্রামের শাপলা খাতুন (২২) কুষ্টিয়া শহরের কাস্টমস মোড়ের শাপলা ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে সিজার অপারেশনের মাধ্যমে পুত্র সন্তান লাভ করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

২০২০ সালের ৯ মার্চ দুপুর ২টায় কুষ্টিয়া শহরের পেয়ারাতলায় পদ্মা প্রাইভেট হাসপাতালে ভূল সিজার অপারেশনে নব জাতক পুত্র সন্তান রেখে প্রসূতি ফাতেমা খাতুন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সে কুমারখালী উপজেলার সাওতা গ্রামের আব্দুর রশিদের স্ত্রী। এ ঘটনায় কিনিক মালিক দেলোয়ার ও মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট নান্নুর বিরুদ্ধে সিজার অপারেশনে অংশগ্রহণের গুরুতর অভিযোগ ওঠে।

২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সাহাদালী ক্লিনিকে ভূল সিজার অপারেশনে ইভা খাতুন।