লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ গ্রামাঞ্চলের মানুষ

সারাদেশ
  © ফাইল ছবি

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ গ্রামাঞ্চলের মানুষজন। সকাল-দুপুরের পাশাপাশি মধ্যরাতেও লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের। সারা দিন রোজা থাকার পর অনেকে এই গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে সেচ কার্যক্রমও।

এখন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও জ্বালানিসংকটে উৎপাদন বাড়াতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। সারা দেশে বিপিডিবির দৈনিক ঘাটতি থাকছে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের বেশি, যার প্রায় পুরোটাই পূরণ করা হচ্ছে ঢাকার বাইরের জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং দিয়ে। অনেক এলাকায় গড়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং হচ্ছে।

বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়িয়েও চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না।

দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি রক্ষণাবেক্ষণের নিয়মিত কাজের জন্য বন্ধ রয়েছে। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহে কিছুটা সংকট চলছে। ঈদের আগেই টার্মিনালটি পুনরায় চালু হবে, এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। তাই শিগগিরই লোডশেডিং পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।

দেশের ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এই প্রতিষ্ঠানটির জোনভিত্তিক লোডশেডিং তথ্যে দেখা গেছে, গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে এই বিতরণ কম্পানিকে দুই হাজার ৩৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। এই সময় সারা দেশে তাদের চাহিদা ছিল আট হাজার ৪৫৬ মেগাওয়াট, সরবরাহ করেছে ছয় হাজার ৪২৩ মেগাওয়াট। গতকাল আরইবির বিতরণ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়েছে ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম এলাকায়।

অস্বাভাবিক লোডশেডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে আরইবির এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল বলেন, ‘গরমের কারণে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আমাদের বিতরণ এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি বেড়ে গেছে। সেই অনুযায়ী বিদ্যুৎ না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে আমাদের লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।’

বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। প্রতিষ্ঠানটির সূত্রে জানা গেছে, গতকাল দুপুর ১২টার সময় এখানে এক হাজার ২৭০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পিজিসিবি দৈনিক প্রতিবেদনে যে বিদ্যুতের চাহিদা ও লোডশেডিং চিত্র দেখানো হচ্ছে বর্তমানে তার চেয়েও এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি রয়েছে।

ঢাকার বাইরে লোডশেডিংয়ের চিত্র

চট্টগ্রাম : তিন সপ্তাহের ব্যবধানে লোডশেডিং বেড়েছে পাঁচ গুণ। আগে দৈনিক গড়ে ৩০ থেকে ৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হতো, তা বেড়ে এখন দৈনিক গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট হচ্ছে। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং বেশি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। তবে ক্যাব বলছে, গ্রামাঞ্চলে দৈনিক ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অশোক কুমার চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘চার-পাঁচ দিন ধরে দৈনিক গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। চাহিদার বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। দৈনিক এখন এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও সেখানে ৯৫০ মেগাওয়াট পাওয়া যাচ্ছে।’ 

ময়মনসিংহ : ভালুকায় রোজার মাসে প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনতা গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় পিডিবি অফিস ঘেরাও করে। পরে লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার আশ্বাসে তারা অফিস চত্বর ছেড়ে আসে। কিন্তু তার পরও থেমে নেই লোডশেডিং, এখনো আগের মতোই ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে।

ভালুকা পৌর এলাকার আতাউর রহমান তরফদারসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, দিনের বেলায় যেমন-তেমন রাতে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ঘুমানো যায় না।

ভালুকার পূর্বাশা কম্পোজিটের এমডি আলী হোসেন বলেন, ‘দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না, যার কারণে ব্যয়বহুল ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালিয়ে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।’

পাঁচগাঁও গ্রামের জালাল উদ্দিন জানান, তাঁর সাত-আট একর বোরো জমিতে মোটরে সেচ দিতে হয়। সেচ মৌসুমে রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা থাকলেও গড়ে দুই ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না।

ভালুকা পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী এ জে এম আনোয়ারুজ্জামান জানান, তাঁর এলাকায় বিদ্যুৎ চাহিদা ২২ মেগাওয়াট, কিন্তু পাচ্ছেন গড়ে ১০ থেকে ১৫ মেগাওয়াট। ফলে বাধ্য হয়েই লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

কক্সবাজার : চকরিয়ার গ্রাহকরা চাহিদার ৫০ শতাংশও বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। রমজানের শেষদিকে এসে জমজমাট হয়ে উঠেছে বিপণিবিতানগুলো। কিন্তু দিনের বড় একটা সময় বিদ্যুৎ না থাকায় বিপণিবিতানের ভেতর প্রচণ্ড গরমে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা।

চকরিয়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রেজাউল হক বলেন, ‘বিদ্যুৎ একবার এলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে যাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হলেও বিদ্যুতের দেখা মিলছে না। এই অবস্থায় চরম দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতা থেকে শুরু করে সবাই।’

বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ চকরিয়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজুল হক বলেন, ‘পিডিবি চকরিয়া কার্যালয়ের অধীনে প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৫ মেগাওয়াট, কিন্তু দোহাজারি ও কক্সবাজার গ্রিড উপকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে মাত্র আট মেগাওয়াট। তাই বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’

টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে আসায় প্রচণ্ড গরমে সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত, শিল্প-কারখানায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। চাষের জমিতে পানি দিতে না পারায় কৃষকরাও চিন্তিত। ভুক্তভোগীরা জানায়, রোজার শেষে সাহরি ও ইফতারের সময়ও লোডশেডিং হচ্ছে। শহর এলাকায় দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পালা করে এলাকাভিত্তিক দফায় দফায় বিদ্যুতের লোডশেডিং দেওয়া হয়। গ্রামের অবস্থা আরো ভয়াবহ।

শহরের সাবালিয়ার সোহেল, কলেজপাড়ার রাসেলসহ অনেকেই জানান, তীব্র দাবদাহে বাসায় থাকা যায় না। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ। শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সর্দি-কাশি, জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।

নাটোর : বাগাতিপাড়ায় প্রতিদিন সাত থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ। অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। রাতে লোডশেডিং হওয়ায় মানুষ ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। লোডশেডিংয়ের কারণে অনেকেই রমজানে ইবাদত ও সাহরিও ঠিকমতো খেতে পারছে না। উপজেলার পৌর এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউন্নবী বলেন, চার-পাঁচ দিন ধরে সারা দিনে কতবার যে বিদ্যুৎ গেছে তার হিসাব নেই।

তথ্য: কালের কন্ঠ