বিদ্যুৎ খাতে ভুল পরিকল্পনার মাশুল দিচ্ছে জনগণ, লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন

লোডশেডিং
  © ফাইল ছবি

সারা দেশেই মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন। আগে দিনে লোডশেডিং হলেও এক সপ্তাহ ধরে মধ্যরাতেও লোডশেডিং হচ্ছে। এখন রাজধানীতেই মধ্যরাতে লোডশেডিং করা হচ্ছে দুই থেকে তিনবার। প্রতিবার আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা থাকছে না বিদ্যুৎ। আর দিনে লোডশেডিংয়ের কোনো সময়সীমা নেই। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র গতকাল সোমবার দুপুরে বন্ধ হওয়ার পর লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। এখন শহরাঞ্চলে দিনে-রাতে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হলেও গ্রামাঞ্চলে করা হচ্ছে ১৩ থেকে ১৪ ঘণ্টা। লোডশেডিংয়ের এ ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য সরকারের ভুল পরিকল্পনাকে দায়ী করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে সব ধরনের সেবা। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুতের অভাবে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে, সিএনজি স্টেশন ও পেট্রোল পাম্পগুলোতে দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। বিদ্যুৎ না থাকায় ওয়াসার পানির পাম্পগুলোতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও খাবার পানি সংগ্রহ করতে পারছেন না গ্রাহকরা। শিল্পকারখানার উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকে। অনেক কারখানা বিদ্যুতের অভাবে বন্ধও রাখতে হচ্ছে। মার্কেটগুলোতেও কমে গেছে বিক্রি।

লোডশেডিংয়ের এ অসহনীয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ছাড়া ভারতের আদানি থেকে আরও বেশি বিদ্যুৎ আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি পায়রা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুলনা অঞ্চলের জ্বালানি তেলনির্ভর সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান।

আরও পড়ুনু: টিকিট বিক্রির আয় নিজ দেশে পাঠাতে পারছে না বিদেশি বিমান সংস্থা

লোডশেডিংয়ের এ ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য সরকারের ভুল পরিকল্পনাকে দায়ী করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে নিজেদের সম্পদের ব্যবহার না করে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পরিকল্পনার ভুলের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম কমলেও বাংলাদেশ সে সুযোগটা নিতে পারছে না। এখন বিশ্ব স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম কম, সেই সুযোগও হাতছাড়া হচ্ছে ভুল পরিকল্পনার জন্য।

পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরকার চলমান লোডশেডিং পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, সপ্তাহখানেক মধ্যে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি করার চেষ্টা করছি। খুলনা অঞ্চলের সব তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালু করার চেষ্টা হচ্ছে। এ ছাড়া ভারতের আদানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি আরও বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। আমরা পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করছি গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে। চট্টগ্রামের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এসএস পাওয়ার (এস আলম) থেকে সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে।

পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, কমবেশি ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে এখন গড়ে উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। জ্বালানি সংকটের কারণে এর বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। দেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৪টি। এগুলোর সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ থাকা কেন্দ্রগুলোর মোট ক্ষমতা ২ হাজার ৭৯ মেগাওয়াট। প্রাথমিক জ্বালানি অর্থাৎ গ্যাস ও তেলের সংকটের কারণে ৫ হাজার ২২৯ মেগাওয়াট কম উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটিসহ অন্যান্য সমস্যায় ৩ হাজার ৬৪১ মেগাওয়াট উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। মোট ১০ হাজার ৭২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এখন উৎপাদন হচ্ছে না। এর মধ্যে খুলনা অঞ্চলে মোট ১৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। জ্বালানি তেল ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ছয়টি এবং ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্র রয়েছে চারটি। বাকিগুলোর মধ্যে একটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র এবং অন্য সবকটি গ্যাসভিত্তিক।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের ভুল পরিকল্পনার কারণে আজকের এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন ডলারের মারাত্মক সংকট চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে এ অবস্থায় বিকল্প কী করতে পারতাম? আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম কমলেও আমরা সুযোগ নিতে পারছি না। এখন বিশ্ব স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম কম। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কিনে আমরা বেশি দামের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করছি। স্পট মার্কেটে এখন ১০ ডলারের নিচে এলএনজির দাম; কিন্তু এ সুযোগটাও আমরা নিচ্ছি না।

ড. ইজাজ আরও বলেন, পরিকল্পনার অভাবে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনেও আমরা এগোতে পারিনি। সঠিক পরিকল্পনা নিলে আমরা দিনের বেলার বিদ্যুৎটা সৌরশক্তি থেকে নিতে পারতাম। কিন্তু সেদিকে নজর দেওয়া হয়নি। দিনে অন্তত ২ হাজার মেগাওয়াট সোলার থেকে পাওয়া যেত। এ ছাড়া দেশে গ্যাস অনুসন্ধানেও কম জোর দেওয়া হয়েছে। এখন এসে বলা হচ্ছে, দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের টাকাও পরিশোধ করাও জরুরি।


মন্তব্য