মে মাসে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের কাছাকাছি; জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব

মূল্যস্ফীতি
  © ফাইল ছবি

বাজারের খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে জাতীয় মূল্যস্ফীতিতে। মে মাসে শহর ও গ্রামে সমানতালে বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। গত মার্চের তুলনায় এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি কমলেও মে মাসে আবারও বেড়েছে খাদ্য ও সার্বিক মূল্যস্ফীতি।

গত মে মাসে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, যা এর আগের মাসে এপ্রিলে ছিলো ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ একমাসে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার ১৫ বেসিস পয়েন্ট। 

আজ সোমবার (০৩ জুন) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশ করা মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্যেেএ চিত্র দেখা গেছে।

গত দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরে বাজেটে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও কার্যত তা বাস্তবায়ন হয়নি। 

এর আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালের জুন থেকে মে পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিলো গড়ে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা লাফ দিয়ে বেড়ে হয়েছে গড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। 

তাই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

বিবিএসের হিসাবে, মে মাসে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমলেও লাফিয়ে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার, বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৪ পয়েন্ট বেসিস। বিবিএসের হিসাবে, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিলো ১০ দশমিক ২২। 

এদিকে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ১৫ বেসিস পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়েছে। 

শহর এলাকায় মুদ্রাস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং গ্রামীণ অঞ্চলে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি কী?

অর্থনীতিবিদরা আগের বছর বা মাসের সঙ্গে অথবা কোন নির্দিষ্ট সময়কালের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে খাদ্য, কাপড়, পোশাক, বাড়ি, সেবা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদানের মূল্য বৃদ্ধির যে পার্থক্য যাচাই করেন সেটাই মূল্যস্ফীতি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "মূল্যস্ফীতি দিয়ে আমরা যেটা বুঝি তা হলো, কোন একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে পরবর্তী আরেকটি সময়ে দাম কেমন বেড়েছে? যেমন ধরুন একটা জিনিসের দাম ২০২৩ সালে ছিল ৫ টাকা, পরবর্তী বছর তা হয়েছে ৬ টাকা। সব জিনিসের দাম তো একইরকমভাবে বাড়ে না। বিভিন্ন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির তথ্য একটি পদ্ধতির মাধ্যমে গড় করে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।''

মূল্যস্ফীতি সাধারণত খাদ্য মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি- এই দুই ভাবে ভাগ করা হয়।

কয়েকভাবে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০২৩ সালের ০৩ জুন মূল্য কী ছিল আর এই বছরের ০৩ জুন কী মূল্য আছে - এই দুইয়ের শতকরা ব্যবধান।

আরেকটি হচ্ছে, এক বছরে জিনিসপত্রের গড় মূল্য আর পরের বছরের ১২ মাসে গড় মূল্যের তুলনা করেও মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।

মূল্যস্ফীতি কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে?

মনে করুন, বাসাবাড়িতে কাজ করা ইয়াসিন মোল্লার স্ত্রী গত বছর যে খরচে সংসার চালিয়েছেন, খাবার কেনা বা বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন, এই বছর আর সেই টাকায় চালাতে পারছেন না। মাস ফুরোবার আগেই টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদিও তার আয় একই রকম আছে।

'গত বছর এই সময় চাল কিনেছে ৬০ টাকা কেজি দরে, একই চালের জন্য এখন দিতে হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা। বাড়ি ভাড়া বেড়েছে এক হাজার টাকা, যাতায়াতের খরচ বেড়েছে।'

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি জানা গেলে বোঝা যায় যে কোন নির্দিষ্ট সেবা বা পণ্যের জন্য আগের তুলনায় একজন মানুষকে কত টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে, এবং তা তার জীবনযাত্রার ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে।

অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান উদাহরণ দিয়ে বলছেন, একজন ব্যক্তি হয়তো গত বছর কোন একটি খাবার ১০০ টাকা দিয়ে কিনতেন। ফলে পাঁচশো টাকায় তিনি পাঁচটা খাবার কিনতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে সেটার দাম হয়েছে ১০৭ টাকা। এখন ওই ব্যক্তির আয়ের কেনা পরিবর্তন না হলে, ৫০০ টাকায় তিনি এখন আর পাঁচটা খাবার কিনতে পারবেন না, তাকে কম কিনতে হবে।

এভাবেই মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে থাকে।

মূল্যস্ফীতি হলে খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, বাড়িভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যায়। মানুষকে এসব সেবা বা পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। আয়ের পরিবর্তন না হলে তখন মানুষ এগুলো প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনতে বাধ্য হন। তাদের সঞ্চয় কমে যায় এবং অন্যান্য খাতের খরচ কমিয়ে ফেলতে হয়।

সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সীমিত এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর। কারণ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেক দ্রব্য তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।

মূল্যস্ফীতি অনেক সময় একেকজনের ওপর একেকভাবে প্রভাব ফেলে।