মা দিবসে কেমন আছেন গাজার মায়েরা

গাজা
  © ফাইল ছবি

আজ ১২ মে, বিশ্ব মা দিবস। সারা বিশ্বই যখন মা দিবস উদ্‌যাপন করছে, তখন পৃথিবীরই এক ছোট্ট প্রান্তের মায়েরা ‘হাতের মুঠোয় জীবন’ নিয়ে আতঙ্কে সময় পার করছেন। তাঁরা হলেন ফিলিস্তিনের গাজার মায়েরা। প্রতি মুহূর্তে তাদের মনে কাজ করছে সন্তানের মৃত্যুভয়। তবে মৃত্যুভয় নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়, তা এই মায়েদের না দেখলে কখনো উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

রাওয়ান্দ মুশতাহা এমনই একজন মা। বাস করতেন ফিলিস্তিনের গাজার পূর্বাঞ্চলীয় শহর শেজাইয়াতে। তিনি যখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, তখন পূর্ব গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েরি বাহিনী। তখন তিনি প্রাণভয়ে পালিয়ে যান দক্ষিণ গাজায়। কিছুদিনের মধ্যেই প্রসব বেদনা ওঠে রাওয়ান্দ মুশতাহার। তিনি ভর্তি হন দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে। তারপরের ভয়াবহ বর্ণনা না হয় রাওয়ান্দার মুখেই শোনা যাক।

‘হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে তেমন কোনো নার্স ছিলেন না। চিকিৎসক ছিলেন হাতে গোনা। ওষুধপত্র নেই বললেই চলে। আমাকে সাধারণ অ্যানেসথেশিয়া দেওয়ার কথা ছিল। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে সেটি দেওয়া গেল না। আংশিক অ্যানেসথেশিয়া দিয়েই আমার অস্ত্রোপচার করলেন চিকিৎসক। আমার পেট থেকে বের হলো তিন তিনটি সন্তান!’ বলছিলেন রাওয়ান্দ মুশতাহা।

মাত্র কুড়ি বছর বয়সী এই মা বলেন, ‘আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়েই খবর শুনলাম, আমার শাশুড়ি, দুই বোনসহ আমার স্বামীর পরিবারের অন্তত ৫০ জন মারা গেছেন ইসরায়েলি বোমা হামলায়।’

রাওয়ান্দাদের বাড়িটা সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেখানে আর ফেরার উপায় নেই। স্বামী বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, সেই খবরও জানেন না। কিন্তু যে তিন সন্তান পৃথিবীতে এল, তাদের তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

রাওয়ান্দ মুশতাহা মাথায় হাত দিয়ে নিজের কপালকে দুষলেন—‘মানুষের হয় জমজ সন্তান, আর আমার হলো তিনটা!’ চোখ মুছে তিন কন্যার নাম রাখলেন মৃত দাদি আর দুই খালার নামে—সুহাদ, হুদা ও নাদা।

এরপর ভয়ানক এক দুর্বিষহ সংগ্রাম শুরু হলো তাঁর। কারণ, গাজার দক্ষিণাঞ্চলেও হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। তিন নবজাতক নিয়ে কোথায় যাবেন এখন? এরই মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে তাঁর স্বামী চলে এসেছেন খান ইউনিসে। স্বামীকে পেয়ে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েন রাওয়ান্দ মুশতাহা। তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর স্বামী মারা গেছেন ইসরায়েলি বোমা হামলায়, তাঁকে আবার ফিরে পাবেন, এ কথা স্বপ্নেও ভাবেননি।

এবার স্বামী আর তিন সন্তানকে নিয়ে দেইর আল-বালাহ শহরে পালিয়ে যান রাওয়ান্দ মুশতাহা। সেখানে একটা তাঁবুতে আশ্রয় নেন তাঁরা। কিন্তু শহরজুড়ে দুর্ভিক্ষ। কোথাও কোনো খাবার নেই। মাঝে মাঝে ত্রাণের গাড়ি আসছে, আর ঝাঁপিয়ে পড়ছে বুভুক্ষের দল। যুদ্ধের মধ্যে এ আরেক যুদ্ধ। মাথার ওপরে বোমা, জমিনে ক্ষুধা। কোথায় যাবেন তাঁরা? তবু এরই মধ্যে লড়াই করে কিছু খাবার নিয়ে আসেন রাওয়ান্দের স্বামী। নিজেরা তাই দিয়ে কোনোমতে জীবন বাঁচান। কিন্তু তিন সন্তানকে খাওয়াবেন কী? তারা যে একেবারেই নবজাতক।

রাওয়ান্দ বলেন, ‘এখানে খাবার নেই, পানি নেই। নিজে খেতে পাই না বলে বাচ্চারা ঠিকমতো বুকের দুধ পায় না। বাজার থেকে দুধ কিনে খাওয়াব, সেই উপায়ও নেই। দু–একটা দোকানে যদিও বা পাওয়া যায়, আকাশচুম্বী দাম। ডায়াপারের দামও লাগামছাড়া। তাঁবুতে দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম আর রাতের বেলা প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমার বাচ্চারা প্রতিদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ওদের মনে হয় বাঁচাতে পারব না।’ কান্নায় ভেঙে পড়েন তরুণী মা রাওয়ান্দ মুশতাহা।

রাওয়ান্দ আর কোনোদিন তাঁর জন্মভিটায় ফিরে যেতে পারবেন কি না, জানেন না। তাঁর মতো লাখ লাখ ফিলিস্তিনি মা কঠিন সময় পার করছেন। জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউ জানিয়েছে, গাজায় অন্তত ১ লাখ ৫৫ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মা পানিশূন্যতায় ভুগছেন।

সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নারী প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৯ হাজার নারী। আর প্রতিদিন গড়ে মা হারাচ্ছে প্রায় ৩৭ শিশু। অর্থাৎ, বেশির ভাগ মা–ই মারা যাচ্ছেন।

গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়। এরপর থেকে গাজায় বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। প্রায় সাত মাস ধরে চলা এই হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজারের কাছাকাছি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

তথ্যসূত্র: আনাদোলু এজেন্সি, আল জাজিরা, রয়টার্স ও এএফপি


মন্তব্য