২৮ বছরে ঢাকার সবুজ কমে দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশে : বিআইপি

ঢাকা
  © ফাইল ছবি

গত ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ এলাকা কমে মাত্র ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদিও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা থাকার কথা বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)। 

শনিবার বেলা ১১টায় বিআইপির উদ্যোগে রাজধানীর বাংলামোটরে প্ল্যানার্স টাওয়ারের বিআইপি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত ‘ঢাকায় তাপদাহ : নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায় ও করণীয়’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপে বিআইপির পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়। 

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ভবনের নকশায় প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচলকে ব্যাহত করে দিয়ে আবদ্ধ ঘর, কাচ নির্মিত ঘর ও এসি ব্যবহারকে মাথায় রেখে ভবন নির্মাণের প্রবণতার কারণে মহানগরীতে তাপমাত্রা বাড়ছে।

সংলাপে আলোচকরা বলেন, ঢাকা মহানগরীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও তাপদাহের প্রভাবের মূলে ভূমি আচ্ছাদন (সবুজ, পানি ও ধূসর বা কংক্রিট আচ্ছাদন) এর মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট, কংক্রিটের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, ভবনের নকশায় পরিবেশ ও জলবায়ুর ধারণা অনুপস্থিত, কাচ নির্মিত ভবন ও এসিনির্ভর ভবনের নকশা তৈরি, সবুজ এলাকা নষ্ট করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, বনায়ন না করাসহ বহুবিধ কারণ রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের ঢাকা শহরে কয়েক দশক আগেও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ সবুজ এলাকা ও জলাশয় বিদ্যমান ছিল। নগর এলাকায় সরু রাস্তার পাশেই সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহ কর্তৃক জলাশয়-জলাধার-সবুজ এলাকা ধ্বংস করা হচ্ছে। ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্প-কারখানার ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট বায়ু দূষণে নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশপাশি বায়ু দূষণে সৃষ্ট অতি ক্ষুদ্র কণার কারণে নগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঢাকার বাতাসে উত্তাপ বাড়াচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস। ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্প-কারখানার ধোঁয়া থেকে তৈরি হচ্ছে গ্যাস।
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউটের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। 

উপস্থাপিত প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে সবুজ যেমন কমেছে, ঠিক তেমনি গত দুই দশকে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধূসর এলাকা ও কংক্রিটের পরিমাণ, যা নগর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে মারাত্মক হারে, বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ড এর প্রভাব।

২০১৯ সালে করা বিআইপির গবেষণা অনুসারে, কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ১৯৯৯ সালে ছিল ৬৪.৯৯ শতাংশ, ২০০৯ সালে বেড়ে হয় ৭৭.১৮ শতাংশ, আর ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮১.৮২ শতাংশে।
২০২৩ সালে বিআইপির প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ এলাকা কমে মাত্র ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে; অন্যদিকে, জলাভূমি নেমে এসেছে মাত্র ২.৯ শতাংশে। যদিও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা। 

ইতিমধ্যে ঢাকার শহরের বায়ুর মানদণ্ড পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত নিম্নমানের মন্তব্য করেন বিআইপির ন্যাশনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লিয়াজোঁ পরিকল্পনাবিদ মো. আবু নাইম সোহাগ । 

বিআইপির বোর্ড সদস্য (রিসার্চ এন্ড পাবলিকেশন) পরিকল্পনাবিদ হোসনে আরা নগরের সবুজ এলাকা হ্রাস ও নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ‘ঢাকার দাবদাহ নিয়ন্ত্রণে এবং তাপ সহনশীল নগর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আরবান হিট মিটিগেশন ও ম্যানেজমেন্ট কৌশল নগর পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ বিবেচনায় আনতে হবে।

এ ছাড়া নগরে বসবাসরত জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে গণপরিসর ও উন্মুক্ত স্থান সৃষ্টি, নগরে সবুজায়ন ও জলাশয় রক্ষা ও বৃদ্ধিতে যথাযথ ভূমি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।’
পরিকল্পনাবিদ মো. রেদওয়ানুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা শহরে ৫ থেকে ১০ শতাংশ জনগণ মূলত এসি ব্যবহার করে থাকে, যা আমাদের ঢাকা শহরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ পাশাপাশি আমাদের জলবায়ুর ক্ষতি সাধন করছে। সরকারের উচিত এ সকল বিলাসবহুল পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা। এবং জনগণকে তা মানার জন্য বাধ্য করা।’

তিনি আরো বলেন, ‘এ সকল কার্বন নিঃসরণ এর পরিমাণ কমানো না গেলে শহরে সবুজায়নের পরিমাণ বৃদ্ধি করলেও তা এই শহরের তাপমাত্রা পরিবর্তনে তেমন একটা ভূমিকা রাখবে না।’

পরিকল্পনা সংলাপে ড. আদিল মুহাম্মদ খান বেইলি ঢাকা মহানগরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) পক্ষ থেকে ২৩টি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। 

যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ হলো―বিদ্যমান প্রতিটি সবুজ ও জলাশয় এলাকা সংরক্ষণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা। জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা অনুযায়ী নগর এলাকায় সবুজায়ন বাড়াতে বৃক্ষরোপণ, বনায়ন বাড়াতে সবুজায়ন মহাপরিকল্পনা, গ্রিন-ব্লু নেটওয়ার্ক পরিকল্পনা, গ্রিন ও ব্লু অবকাঠামো সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ, ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান এবং তাপদহ থেকে রক্ষা পেতে জনগণকে প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থা। নগর পরিকল্পনার যথাযথ মানদণ্ড নিশ্চিত করে কার্যকর নগর পরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার মাধ্যমে সবুজ এলাকা, জলাশয় ও কংক্রিট এলাকার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হওয়া। নগর এলাকার প্রান্তে সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প গ্রহণ করা। নগর এলাকার সড়কের ধারে ও ফুটপাতের পাশে বৃক্ষায়নের উদ্যোগ বাড়ানো ইত্যাদি।


মন্তব্য