ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে কলকাতায় ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় এমপি আনারকে!

এমপি আনার
  © সংগৃহীত

গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সামনে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। দিনভর নানান গুঞ্জনের পরে জানা গেলো, হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার আক্তারুজ্জামান শাহীন।

তিনি ঝিনাইদহের বাসিন্দা ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। শাহীনের ভাই ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র। এই হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আরেক বন্ধু ও চরমপন্থি নেতা আমানউল্লাহ আমানকে।

এমপি আনারকে হত্যার কারণ

১২ মে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের ফোনে বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক সহযোগী আখতারুজ্জামান শাহীনের একটি কল আসে। ফোন করে শাহীন জানান, তিনি আজীমের সঙ্গে একটি ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে ইচ্ছুক।

দুজনের বৈঠকের জন্য তিনি ভারতের কলকাতাকে বেছে নেন। আনোয়ারুল আজীম তার পরিবারকে জানান, তাকে একটু ভারত যেতে হচ্ছে চিকিৎসার কাজে।

সন্ধ্যার একটু আগে আগেই এমপি আজীম ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তিনি দর্শনা হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন।

আনোয়ারুল আজীমের হত্যারহস্যের স্বাভাবিক ঘটনাচক্রের সমাপ্তি এখানেই বলে জানাচ্ছে পুলিশের একাধিক সূত্র। এরপর থেকেই শুরু হয় রহস্যের বেড়াজাল।

কলকাতা যাওয়ার পর বাংলাদেশের এ জনপ্রতিনিধি আর দেশে ফেরেননি। বরং তার শরীরের বিচ্ছিন্ন অংশ পাওয়া গিয়েছে কয়েকদিন পর।

পুলিশের সূত্রসমূহের সন্দেহ, আজীম হয়তো সোনা চোরাচালানকারী একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয়েছেন। এ চোরাচালানের মাসিক লেনদেন প্রায় ১০০ কোটি টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বুধবার (২২ মে) আনোয়ারুল আজীমের মৃত্যু নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আজীমের বিরুদ্ধে হুন্ডি, নারীপাচার ও সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়।

এ প্রসঙ্গে আইজিপি বলেন, 'ভারতীয় পুলিশের পাশাপাশি আমরাও এ ব্যাপারে কাজ করছি। বিষয়টি নিয়ে এত তাড়াতাড়ি মন্তব্য করা যাবে না। যথাসময়ে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।'

কলকাতায় গিয়ে আনোয়ারুল আজীম দীর্ঘ ২৫ বছরের পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন।

সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজীম আর ফেরেননি। টানা সাতদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। উদ্বিগ্ন হয়ে শেষমেশ গোপাল বিশ্বাস স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের করেন।

এমপি আনারকে যেভাবে হত্যা করা হয়
আনারকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডের আগে আমানকে কিছু টাকা দেওয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের পর বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

জানা যায়, কলকাতায় বসে হত্যার চূড়ান্ত ছক এঁকে বাংলাদেশে চলে আসেন শাহীন। পরে আমানসহ ছয়জন মিলে এমপি আজীমকে সঞ্জীবা গার্ডেন নামের একটি ফ্ল্যাটে ট্র্যাপে ফেলে ডেকে আনেন। এরপর তাকে জিম্মি করে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। পরে মরদেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ট্রলি ব্যাগে ভরে ফেলা হয় অজ্ঞাত স্থানে।

মিশন সফল হওয়ার পর আনারের মরদেহের টুকরোগুলো গুম করার জন্য সিয়াম ও জিহাদ নামের দুজনকে দায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন আমান। ঢাকায় এসে আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে দেখা করেন। তবে শাহীন পরবর্তীতে আমানকে কত টাকা দিয়েছেন সেটা জানা যায়নি।

এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগ। তারা হলেন- হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানউল্লাহ আমান, মোস্তাফিজ ও ফয়সাল।

গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আমান জানিয়েছে, এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডের আগে তাকে কিছু টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল হত্যাকাণ্ডের পর।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরের বোনের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন আমান। সেখান থেকেই তাকে আটক করা হয়েছে।

হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা ও আরও কিছু রহস্য

 ১২ মে সন্ধ্যা ৭টায় আনোয়ারুল আজীম তার বাড়িতে পৌঁছান। জানান, তিনি কলকাতায় এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। পরদিন দুপুর পৌনে দুইটার দিকে আজীম বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বলেছিলেন, তার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হবে।

কিন্তু সন্ধ্যায় আজীমের নাম্বার থেকে গোপাল বিশ্বাসের হোয়াটসঅ্যাপে একটি বার্তা আসে। সেখানে লেখা ছিল, তিনি [আজীম] জরুরি কাজে দিল্লি যাচ্ছেন।

'পৌঁছে তোমাকে খবর দেব। ফোন করার দরকার নেই,' আরও বলা হয় ওই বার্তায়।

১৫ মে সকালে আজীমের নাম্বার থেকে আরেকটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পান গোপাল বিশ্বাস। 'আমি দিল্লি পৌঁছে গেছি। আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন, ফোন করার দরকার নেই।'

আজীমের পরিবার এবং তার ব্যক্তিগত সহকারীও তার নাম্বার থেকে একই বার্তা পান।

১৬ মে সকালে আজীমের নাম্বার থেকে তার সহকারীর কাছে একটি ফোন আসে। কিন্তু সহকারী সেটা ধরতে পারেননি। একটু পরই তিনি আজীমের নাম্বারে ফোন করলেও কেউ ফোন ধরেনি।

এরপর থেকে আর কোনোভাবেই তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। স্বাভাবিকভাবে উৎকণ্ঠা ছড়ায় তার বাংলাদেশের বাসায়। পাশাপাশি গোপাল বিশ্বাসও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এরপরই কোনও উপায় না দেখে গত ১৮ মে শনিবার বরানগর থানায় একটি নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করেন গোপাল বিশ্বাস।

জিডিতে গোপাল বিশ্বাস লিখেছেন, গত ১৩ মে দুপুর দেড়টার পর ডাক্তার দেখানোর কথা বলে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান আনোয়ারুল আজীম আনার। যাওয়ার সময় বলে যান, দুপুরে খাবো না, সন্ধ্যায় ফিরে আসবো। যাওয়ার সময় নিজে গাড়ি ডেকে বরাহনগর বিধান পার্ক কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে গাড়িতে উঠে চলে যান। এরপর তিনি সন্ধ্যায় বরাহনগর থানার অন্তর্গত মণ্ডলপাড়া লেনে বাড়িতে না ফিরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেন, আমি বিশেষ কাজে দিল্লি যাচ্ছি। গিয়ে ফোন করবো, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।

গোপাল বিশ্বাস মিসিং ডায়েরিতে আরও লিখেছেন, গত ১৫ মে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে জানান, আমি দিল্লি পৌঁছালাম, আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছে, ফোন করার দরকার নেই।

এদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করা হয়েছে।

বুধবার (২২ মে) অপহরণের অভিযোগে মামলাটি করেন এমপি আনারের মেয়ে মুনতারিন ফেরদৌস ডরিন। তবে এতে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। সন্ধ্যায় শেরেবাংলা নগর থানায় মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আহাদ আলী।


মন্তব্য