‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: নেতৃত্বশূন্য বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের নতুন জীবন লাভ’

মতামত
‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: নেতৃত্বশূন্য বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের নতুন জীবন লাভ’  © ফাইল ফটো

১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ৪৩ তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৮১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ অমানিশা অতিক্রম করে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে মুক্তিকামী মানুষদের আহ্বানে দেশে আসেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতার হত্যার পর দীর্ঘ ৬ টা বছর তার কন্যা স্বদেশে আসতে পারেননি ৷ তাকে আসতে দেয়া হয়নি ৷ স্বজন হারালে ধর্মীয় রীতিতে শেষকৃত্য সম্পন্ন পরিবারের সদস্যদের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকার ৷ কিন্তু শেখ হাসিনা তার পিতা সহ পুরো পরিবারকেই শেষ চোখের দেখা দেখতে পারেন নি ৷ বিভীষিকাময় সেই সময়ের কথা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে ।

জাতির জনকের হাত ধরে স্বাধীনতা অর্জন ছিল বাংলাদেশের প্রথম বিপ্লব। তার স্বপ্ন ছিল সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন যেখানে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের পেটে খাবার থাকবে এবং মুখে হাসি ফুটবে। স্বাধীনতার ৩ বছরের মাথায় তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল হয়নি। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটি আর মাথা উঁচিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি ৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক দিকগুলো–গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ–পরিবর্তন হতে থাকে। ব্যক্তি স্বার্থ ও ধর্মীয় ভাবধারাকে মূলমন্ত্র ধরে একে একে রাষ্ট্রের মূল স্পিরিটের উপর আঘাত হানা হয়। দীর্ঘ হতে থাকে সামরিক শাসন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষগুলো ধরে নিয়েছিলো বাংলাদেশ হয়ত দিক হারিয়ে পাকিস্তানের ভাবধারায় ধর্ম ও সামরিক বাহিনীর দ্বারা চালিত হবে। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বপ্নের উপর প্রথম আঘাত।

পড়ুন>>> আজ শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

এ দেশে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (ভারত থেকে) দিন থেকেই রাজনীতির মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। সেনাশাসক জিয়া এত দিন তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের রুখে দেয়ার জন্য এমন কোন চেষ্টা নেই যা করেন নি। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের আগে সেই বছরই শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং জিয়ার নীলনকশা ভেস্তে যায়। সেদিনের ঢাকায় লাখো মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত তাকে কেন্দ্র করে সমবেত হয়েছিল। তাদের কণ্ঠে ছিল বিচিত্র ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি। ‘শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ আরো ছিল ‘শেখ হাসিনা আসছে, জিয়ার গদি কাঁপছে, গদি ধরে দিব টান জিয়া হবে খান খান।’ আবালবৃদ্ধ জনতা আবেগে অশ্রুসিক্ত হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব।’ সেদিনের প্রত্যয় শেখ হাসিনা ও তার সরকারই বাস্তব করে তুলেছেন। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাকি পলাতক আসামি ফিরিয়ে এনে শিগগিরই ফাঁসি দেওয়া হবে বলে আমরা মনে করি।

১৯৮১ সালে জাতির পিতার কন্যা যখন নিজভূমে এসেছিলেন তখন চারিদিকে শুধু সংকট আর হাহাকার ছিল, কি রাষ্ট্রব্যবস্থা কিংবা মানুষের অধিকার সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশ চলছিল প্রত্যাশার বিপরীতে। এরপর পদ্মা মেঘনায় গড়িয়েছে অজস্র জল, সময়ের পরিবর্তনের সাথে ইতিহাসের গতিপথ কতটা বদলেছে তা সকলেরই জানা ৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা এখন সত্যিকারের স্টেটসম্যান। তাঁর ৪৩ তম স্বদেশ প্রত্যাবতর্নের প্রাক্কালের বাংলাদেশ আর সেই সময়ের বাংলাদেশের চিত্র সামনে আনলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করার জন্য পণ্ডিত হওয়ার দরকার হয়না। অন্ধকার থেকে আলোর পথে এই যাত্রা, পিতার অসমাপ্ত কাজকে শেষ করার জন্য নিজেকে সঁপে দেয়া এই পথটা সহজ ছিল না ৷ কবিগুরুর ভাষায়,-"অন্ধকারের সিন্ধুতীরে একলাটি ঐ মেয়ে, আলোর নৌকা ভাসিয়ে দিল আকাশপানে চেয়ে" ৷ ঘরে বাইরে অজস্র বাধা অতিক্রম করে, ২২ বার মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেও তিনি পিতার মতো দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টায় মগ্ন ৷

বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনই বাংলাদেশের মৌলিক দিকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। এ মৌলিক দিকগুলোর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ আজ একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। শেখ হাসিনা ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর হাত ধরে এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং উন্নয়ন পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদও এগুলো স্পর্শ করতে পারেননি। এ অর্জন অনন্য ও অতুলনীয়। তিনি টানা ৪৩ বছর দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সভাপতি। ১৯ বছরের বেশি সময় চতুর্থবারের মতো সরকার পরিচালনা করছেন। ৭৫ পরবর্তী সময়ে বিপন্ন গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ইতিহাসের সঠিক ধারায় এনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন । ৩৬ টির বেশি আন্তর্জাতিক পদক ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন এবং চল্লিশটির অধিক বই লিখেছেন।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার অর্জনের জন্য ছিল এক মাইল ফলক। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাসহ বৃহত্তর কৃষির সব সেক্টরে এসেছে এক অভাবনীয় সাফল্য। তিনি লাখ লাখ গৃহহীন মানুষকে গৃহ দিয়েছেন। বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুসহ অবকাঠামো উন্নয়নে এক নবজাগরণ ঘটিয়েছেন। ১২ বছর আগের মাথাপিছু আয়কে চার গুণ বাড়িয়েছেন। তার শাসনকালে দেশের রিজার্ভ ৪৮.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। HDI-সহ সব INDEX এ বাংলাদেশকে বিশ্বের উন্নত দেশের কাতারে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ৫৭তম দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণসহ বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি চলছে।

সমুদ্র বিজয় (BLUE ECONOMY), দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যার সমাধান, পার্বত্য শান্তিচুক্তি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ যুগে প্রবেশ, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, ICT ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়নসহ সফলভাবে করোনা মোকাবিলা করে বিশ্বের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকা ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। একজন রাজনৈতিক নেতা ভিশনারি বলেই জটিল এ বিশ্বব্যবস্থায় সমস্ত প্রতিকূলতা পরিহার করে সাম্যের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা যে স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণা দিয়েছেন সেটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশর মানুষ উন্নত দেশের মতো করে সেবা গ্রহণ করতে পারবেন বলে মনে করি। সেই লক্ষ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ ডেল্টা প্ল্যান সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি বদ্বীপ ২১০০ পরিকল্পনার ভিত্তিও রচিত হয়েছে।

দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে ভালোবাসা, তা অনন্য। চার দশক আগে যদি তিনি আওয়ামী লীগের হাল না ধরতেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী না হতেন, তাহলে আজ এ উন্নতি, এ অগ্রগতি হতো সুদূরপরাহত।দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হতো না, গণতন্ত্র থাকতো না।

ছোট-বড় সব প্রকৃতির নেতৃত্বের জন্য নেতাকে নৈতিকভাবে শক্তিমান ও বিতর্কমুক্ত হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনবদ্য নেতৃত্বের নেপথ্য কারণ এটিই। নৈতিকতার প্রশ্নে তাকে কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়নি। এজন্য রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকে নেতৃত্ব প্রদান ও আস্থা ধরে রেখে তিনি সব সময় পারঙ্গমতা দেখাতে পেরেছেন। আর অত্যন্ত পরিশ্রমী হওয়ায় তিনি সুচারুভাবে তার দায়িত্ব পালন ও লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছেন।বাংলাদেশের আজকের অবিস্মরণীয় উত্থানের অবিকল্প সারথি জননেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশে ফিরে আসা সত্যিকারার্থে ছিল বাংলাদেশের পুনর্জাগরণ।

লেখক:
ড. রফিকুল ইসলাম (রফিক শাহরিয়ার)
অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


মন্তব্য