উন্নয়ন মহাসড়কের ঘোড় সওয়ার বাংলাদেশ

বাংলাদেশ
মাহাবুব আলম, লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

স্বাধীনতা মানুষের সর্বাধিক আরাধ্য ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়। পরাধীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল অনেক আগে। সেই থেকে পরাধীনতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে স্বাধীনতার জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংগ্রাম করেছে বাঙালি জাতি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ৫০ বছর পর কেমন হবে তা বলা ছিল বেশ কঠিন। সেসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যায়িত করা হতো এবং তা এখন কেবলই অতীত। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল।  

এটা সবার জানা কথা যে, ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আর তার ৫০ বছর পেরোতে না পেরোতেই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেল হিসেবে আখ্যা দিলেন। 'Bangladesh is considered as a role model for other developing economies in achieving sustainable development' said former United Nations secretary-general Ban Ki-moon.

স্বাধীনতার ৫০ বছরে জিডিপির আকার বেড়েছে ২৭১ গুণ। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৪,২৯৪ কোটি টাকা যা ২০২৩ সালে এসে চলতি মূল্যে জিডিপি দাঁড়িয়েছে ৪৪,৩৯,২৭৩ কোটি টাকা যার চলতি মূল্যে মাথা পিছু জিডিপি দাঁড়ায় ২,৫৯,৯১৯ টাকা বা ২,৬৫৭ মার্কিন ডলার। ১৯৭২ -৭৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৫% যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৭.৫% । বাংলাদেশ এখন ৩৫ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ যা স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অনেক বড় অর্জন। বাংলাদেশের এ ধারা অব্যহাত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় বেড়েছে ৩০১ গুণ। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাথা পিছু আয় ছিল ৯৪ ডলার (৫৮০) টাকা আর ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে চলতি মূল্যে মাথা পিছু জাতীয় আয় দাঁড়িয়েছে ২৭৬৫ মার্কিন ডলার (২,৭০,৪১৪ টাকা)। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাজেট বেড়েছে ৭৬০ গুণ। ১৯৭২ সালের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর সরকার ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। ৫০ বছর পর তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাজেট ঘোষণা করেছেন ৭,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা । পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৯৬ গুন। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি ছিল ৩৪.৮৪ কোটি মার্কিন ডলার আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে যথাক্রমে রপ্তানি হয়েছে ৬,৪৩৯.৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৪,৯০৬.১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য যা দেশের মোট রপ্তানির ১৭.৩৭% ও ১৩.২৩%।

এ ছাড়াও স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিল্প কারখানা ও ব্যাংকের সংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে। ১৯৭৩ সালে যেখানে ৩১৩টি শিল্প কারখানা ছিল তার সংখ্যা বর্তমানে ৪৬,২২৯ টা আর ব্যাংকের সংখ্যা ৬টি থেকে হয়েছে ৬১ টি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বৈদাশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে বহুগুণ। যদিও অতি সম্প্রতি করোনা মহামারির প্রভাব এবং ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমান সাম্প্রতিক তথ্যের তুলনায় কমেছে যা বর্তমানে ২৩.৫৭ বিলিয়ন ডলার কিন্তু তা ১৯৭১ সালে ছিল ৩ কোটি ডলারে। এতক্ষন আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির অর্জন দেখলাম যা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত করছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছে। একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠিই হল এর অর্থনৈতিক অগ্রগতি। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসরমান তা নিচের এই উক্তিই বলে দেয়।

'Bangladesh's economy has gone from a basket case to being a model case study for economic development across the globe.The country's economy has grown at a pace that beat all expectations' .--Kaushik Basu, a former chief economist of the World Bank

বাংলাদেশ সরকারের কিছু দূরদর্শিতাপুর্ণ সিদ্ধান্ত এবং প্রকল্প বাংলাদেশকে উন্নয়নের মাইলফলক স্পর্শ করতে সাহায্য করেছে। যোগাযোগ ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সাফল্যে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের স্বর্ণ শিখরে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা -আশুলিয়া এলিভাটেড এক্সপ্রেসওয়ে , পদ্মা বহুমুখি সেতু ,পদ্মা সেতু রেলসংযোগ , ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ( লাইন-১), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু , ঢাকা ম্যাস রেপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৬) , দোহাজারি রামু -কক্সবাজার গুন্দুম রেলপথ ,পায়রা সমুদ্র বন্দর , মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ,মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র , সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর , এল এন জি টার্মিনাল , বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প , ঢাকা শহরের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বৃহত্তম বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প ,পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র , পাতাল রেল ,বঙ্গবন্ধু টানেল ,মৈত্রী সেতু ১, তিস্তা মহা পরিকল্পনা ,হাওরে আভুরা সড়ক , অষ্টম বাংলাদেশ -চীন মৈত্রী সেতু , বি,আর,টি ( বাস রেপিড ট্রানজিট) , দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতী সেতু , তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু প্রভৃতি বাংলাদেশ কে ডিজিটাল ও আধুনিক বাংলাদেশে রূপান্তর করেছে।

কোন দেশ যোগাযোগ ও প্রযুক্তিতে উন্নতি করতে না পারলে আধুনিক বিশ্বে সে দেশ পিছিয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ঠিক এ জায়গাতেই উন্নয়নের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে । বাংলাদেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করা হয় ২১ মার্চ ২০২২ সালে । যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় সাফল্য আসছে তার পিছনে মুল ভূমিকা বঙ্গবন্ধু -১ স্যাটেলাইট যা দেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ। ২০১৮ সালের ১১ মে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্পেস এক্স থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় । বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট যা দেশের দ্বিতীয় কৃত্রিম স্যাটেলাইট এবং এটিকে আর্থ অবজারভেটরি হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর সাবমেরিন থাকা দেশসমুহের মধ্যে ৪১ তম। এছাড়া সাবমেরিন কেবল SEA-ME-WE -4,SEA-ME-WE-5,SEA-ME-WE-6 প্রভৃতির মালিক যার দরুণ বাংলাদেশ আজ তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে রয়েছে । ডিসেম্বর ২০,২০২২ সালে ১০০ রাস্তা- মহাসড়ক উদ্ভোধনের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করেন । প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত ,জনসংখ্যাধিক্যসহ নানা সমসস্যায় জর্জরিত ক্ষুদ্র এ দেশটি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিশ্ব দরবারে একটি শক্তিশালী অবস্থান দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংক , আইএম এফ ,জাতিসংঘসহ প্রায় সকল বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান আজ বাংলাদেশের অগ্রগতিকে "বিস্ময়কর" হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কেহ কেহ আবার বাংলাদেশকে এশিয়ার উদীয়মান ব্যাঘ্র বলেও অভিহিত করেছেন। এতসব অগ্রগতি ও ধারাবাহিকতাকে বিবেচনা করেই বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে উন্নয়ন মহাসড়কের ঘোড় সওয়ার হিসেবে দেখছেন। তবে এ কথা সত্য যে , একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে বাংলাদেশকে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। সামনের এ পথকে পাড়ি দিতে ,সামনে এগিয়ে চলার এ পথকে মসৃণ করতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার "ভিশন-২০২১'' ও '' ভিশন-২০৪১'' নামে দুটি বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে ।

‘ভিশন-২০২১’ এর আওতায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নেয়া হয়েছে । এবং এর আওতায় এসডিজি ১৭ গোলের প্রথম গোল দারিদ্র্য বিমোচন বাস্তবায়ন করে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ % এবং চরম দারিদ্র্যের হার ১০.৫% এ নামিয়ে আনা হয়েছে। এস ডি জি ১৭ গোলের ৭ নাম্বার গোল পুরাপুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং অন্যান্য গোল অগ্রগতির পথে যা ২০৩০ এর মধ্যে বাস্তবায়ন করআ হবে যা এজেন্ডা ২০৩০ নামে পরিচিত । একইভাবে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণে গৃহীত হয়েছে ভিশন-২০৪১। এ ছাড়াও ডেল্টা প্লান ২১০০ এবং প্রধানমন্ত্রীর দশটি টি বিশেষ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দুর্নীতি রোধ করে মহা পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে আরো এগিয়ে যাবে। সমৃদ্ধ ও উন্নত সোনার বাংলা বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরেই অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ।


মন্তব্য