বিসিএসের সংস্কারঃ এ কেমন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড

বিসিএস
  © টিবিএম ফটো

"বিসিএসের পরীক্ষাপদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। গত কয়েকটি বিসিএসের ফল মূল্যায়ন করার পর দেখা গেছে, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বেশি প্রশ্ন করা হচ্ছে। এ কারণে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা চাকরিপ্রার্থীরা পরীক্ষায় বেশি সুবিধা পাচ্ছেন।

গত ৪০তম বিসিএসের ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা চাকরিপ্রার্থীরা বেশি সুবিধা পেয়েছেন। কারণ, প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় বিজ্ঞানের নানা বিষয় থেকে প্রশ্ন হয়। এতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আসা চাকরিপ্রার্থীরা যতটা ভালো করেছেন, সে তুলনায় মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে আসা চাকরিপ্রার্থীরা ততটা ভালো করতে পারেননি।"

সুত্রঃ প্রথম আলো

বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ২০০ নম্বরের হয়। এর মধ্যে বিজ্ঞান ১৫ নম্বর আর গণিতে ২০ নম্বর  থাকে। হিসাব করলে দাঁড়ায় মোট নম্বরের মাত্র ১৭.৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকে "বিজ্ঞান" বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য। সেই প্রশ্ন করা হয় লিটারেলি নাইন-টেনের পাঠ্যবই থেকে।  

এবার আসি বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায়। জেনারেল ক্যাডারের জন্য মোট নম্বর ৯০০। এর মধ্যে বিজ্ঞানে ১০০ আর গণিতে ৫০ নম্বন! মানে ১৭ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের জন্য। বাকী ৮৩ শতাংশ নম্বর- বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ বিষয়াবলি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি। যা মানবিক বিভাগ থেকেই আসে। এই ১৫০ নম্বর নিয়েও নাকি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা বেশি প্রিভিলেজ পায়! বাকী ৭৫০ নম্বর এর কোন খোঁজ নাই।

যাদের বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে এত পেরেশানি, তাদের কি ধারণা বিজ্ঞান থেকে প্রশ্ন করা কমালে আর আর্টস থেকে বেশি প্রশ্ন করলে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা পারবে না? যে মাথা জটিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর থিওরি বুঝে, বায়োকেমিস্ট্রির জটিল জটিল রিঅ্যাকশন বুঝে, ফিজিক্স এর কঠিন কঠিন ইকুয়েশন মনে রাখে, মেডিকেল সাইন্সের মোটা মোটা বই ঠোটস্থ রাখে, তারা ইতিহাস, ভূগোল আর বাংলা সাহিত্য দেখলে দৌড় দিবে ভয়ে? হাস্যকর! 

দুনিয়ার সব জাতি দিন দিন আগায়, আর আমরা পিছাই। জিম্বাবুয়ের মত দল অস্ট্রেলিয়াকে তাদের মাটিতে হারায়, আর আমরা দুবাই থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান আর দেউলিয়া শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে এসেছি। কেন? কিছু কারণ তো আছেই। এর একটা বড় কারণ আমার মনে হয় আমরা লড়তে ভয় পাই। লড়াকু মানসিকতাই আমাদের হারিয়ে গেছে। আমাদের সব রেডি করে হাতে ধরে খাইয়ে দিলে আমরা খাবো, নয়তো না। প্রতিযোগিতা করে জিততে পারবো না, কাজেই প্রতিযোগীকেই সরাও। এটাই আমাদের মনোভাব।

কিন্তু, এভাবে বিজ্ঞান বাদ দিলেই বিসিএস থেকে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের দূরে রাখা যাবে না। আর তিক্ত সত্যিটা হল, দেশসেরা মেধাবী যারা, তারা বিসিএস পরীক্ষা দিলে শুধু বিজ্ঞান বাদ দিয়ে কেন, গ্রীক মাইথোলজি আর হিব্রু ভাষা থেকে প্রশ্ন করলেও তারা এগিয়ে থাকবেই। যে পরিশ্রম করতে পারে, তার কাছে কঠিন কিছুই না। বিজ্ঞান আর গণিত থেকে যে ১৫-১৬ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ থাকতো সেটাও যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে বিসিএস পরীক্ষার গুণগত মান নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। পাশের দেশ ভারতের ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার প্রশ্নের ধরণ দেখলে মাথা ঘুরাবে যে কারোর। এখন দরকার বিসিএসের সিলেবাস পরিমার্জন করে আরও উন্নত করা, আন্তর্জাতিক মানের সিলেবাস প্রণয়ন করা, আর সেখানে গণিত-বিজ্ঞানের সিলেবাস কমিয়ে তা কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা আমার কাছে বোধগম্য না। 

যদি সত্যিই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের বিসিএস দেয়া কমাতে হয় (কারণ তাদের সাথে মেধায় প্রতিযোগিতা করার সাহস নেই), তাহলে সবার আগে দেশে তাদের উপযুক্ত পেশা ও সম্মানজনক পরিবেশ এবং কাজের ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। কী কারণে একজন চিকিৎসক ৫ বছর অমানুষিক পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে এমবিবিএস পাশ করে আবার বাংলা সাহিত্যের বই নিয়ে পড়তে বসতে বাধ্য হয়, সেটা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন প্রকৌশলী কেন তার মেধাকে গবেষণার কাজে না লাগিয়ে গায়ে পুলিশের ইউনিফর্ম জড়িয়ে নেয়া বেশি গৌরবের মনে করে সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। 

দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক সরকারি চাকরির পরীক্ষা হবে তুমুল প্রতিযোগিতামূলক, সেখানে দেশের শীর্ষ মেধাবীরা উঠে আসবে মেধার স্বাক্ষর রেখে এটাই কাম্য। মেধার সাথে প্রতিযোগিতা হোক মেধার, এখানে কে বিজ্ঞানের আর কে মানবিকের সেটা মুখ্য না হোক।

লেখকঃ
প্রশাসন ক্যাডার
৪০তম বিসিএস
মেধাক্রমঃ ৬৪


মন্তব্য