ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, কী ঘটছে এই আইনে?
- মোমেন্টস ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:৪০ PM , আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০৫:০২ PM

বাংলাদেশের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের পাঁচ বছর চলছে। সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন এই আইন সমাজে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ভয়ের আবহ প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছে। এই আইনে সরকারি লোকজন প্রতি মাসে গড়ে চারটি করে মামলা। গত চার বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগই বেশি হয়েছে।
আজ শনিবার ‘কী ঘটছে: বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ব্যবহারপ্রবণতা ও নিদর্শন’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আলোচকেরা এসব মত তুলে ধরেন। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
ওয়েবিনারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা, অভিযুক্ত, আটক, আটক ব্যক্তিদের পরিচয় ও মামলাকারীদের পরিচয়সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক ও সিজিএসের উপদেষ্টা আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ভীতির পরিবেশ তৈরি করাই ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন সবাই সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকেন, প্রতিবাদ না করেন।
ওয়েবিনারে আলোচকেরা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই আইনে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। প্রয়োজনে ১৫ দিন সময় বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ৭৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে না। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিচারের আগেই দীর্ঘদিন আটক থাকেন। গত ৪ বছরে ১৮ বছরের কম বয়সী অন্তত ২৬ কিশোর এই আইনে অভিযুক্ত হয়ে জেল খেটেছে।
ওয়েবিনারে জানানো হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন গত ৪ বছরে ১ হাজার ১০৯টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত ২ হাজার ৮৮৯ জন। এর মধ্যে আটক হয়েছেন ১ হাজার ১১৯ জন। যা মোট অভিযুক্ত মানুষের ৩৮.৭৪% আটক হয়েছে। তবে এটা মামলার পরিপূর্ণ চিত্র নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মামলার তথ্য প্রকাশ করতে চায় না। তারাও ভয়ে থাকেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলায় ১ হাজার ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে বলে ওয়েবিনারে জানানো হয়। এর মধ্যে ৩০১ জন রাজনীতিবিদ। ২৮০ জন সাংবাদিক রয়েছেন । শিক্ষার্থী ১০৬ জন এবং শিক্ষক আছেন ৫১ জন। তবে অভিযুক্ত অন্যদের চেয়ে শিক্ষার্থীদের আটকের হার বেশি। মোট অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭১ শতাংশই আটক হয়েছে।
ওয়েবিনারে আরও জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ১৪০টি। এসব মামলায় অভিযুক্ত ২১০ জন, এর মধ্যে আটক হয়েছেন ১১৫ জন।
আলোচকেরা বলেন, ফেসবুকে জনগণের কণ্ঠরোধ নীরব করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হয়েছে। মাসে গড়ে ৯টি মামলা হয়েছে ফেসবুকে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে। মোট ৬৯৮টি মামলা হয়েছে ফেসবুককেন্দ্রিক। এর মধ্যে হয়রানির মামলা ৭৬টি, আর্থিক প্রতারণা ৪৪টি এবং ধর্মীয় অবমাননার ১১৫টি মামলা। বাকি ৪৬৩টি রাজনৈতিক মামলা বলেই প্রতীয়মান হয়।
আলোচকেরা বলেন, সাংবাদিকদের জন্য কঠিন হয়ে এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। বিশেষ করে আঞ্চলিক সাংবাদিকেরা বেশি ঝুঁকিতে। ২০২০ সালে এই আইনের অধীন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে চারটি করে মামলা করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এই আইনের ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারায় মামলা বেশি হয়েছে। ২৫ ও ৩১ ধারা দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে আদালতও প্রশ্ন তুলেছিলেন।
আইনটি বাতিলের জন্য সম্পাদক, সাংবাদিক, অধিকার কর্মী ও অনেক রাজনৈতিক দল দাবি করলেও সরকার বরাবরই এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
আলোচনায় গ্লোবাল টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যায়, গত চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগ হয়েছে বেশি। জামিন-অযোগ্য ধারার নিবর্তনমূলক ব্যবহার বেশি হয়েছে। প্রগতিশীল গোষ্ঠী এই আইনে বেশি আক্রান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এলিনা খান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। একসময় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার অপব্যবহার হয়েছে, সেটারই নতুন আকার পেয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। পরিসংখ্যান বলছে, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক—সবাই ঝুঁকিতে আছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে একটি মন্দ আইন বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, সর্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল এই আইনের উদ্দেশ্য।