‘সবাই স্কুলে যায়, আমি তাগো কাছে বেলুন বেচি, আফসোস লাগে’
- মোমেন্টস ডেস্ক
- প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৫১ AM , আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৫১ AM

বাতাসে ভেসে আছে বাঘ, সিংহ, গরু, তিমির মতো নানা প্রাণী। আদতে সেগুলো ওই সব প্রাণীর আদলে তৈরি রঙিন বেলুন। ফাগুনের রোদ মাথায় নিয়ে বেলুনের সুতাগুলো ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে এক কিশোর। হাত অদলবদল করার সঙ্গে বেলুনগুলো কখনো সোজা মাথার ওপর, কখনোবা পিঠের দিকে ভাসছিল। ছেলেটার পরনে জিনসের রংচটা প্যান্ট, টি-শার্টের ওপর ফুলহাতা আরেকটা শার্ট। ঠোঁটের ওপরে হালকা গোঁফের রেখা।
বছর পনেরোর ওই কিশোরের নাম হৃদয় মুন্সী। বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজ খুলনার গেটের অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। হৃদয়ের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার কমলাপুর গ্রামে। কমলাপুর আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরে সেখানকার স্থানীয় বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে হৃদয়। তবে পরিবারের হাল ঠিক রাখতে এ বছর মাত্র তিন দিন স্কুলে যেতে পেরেছে সে। যে সময়ে তার বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই সময়ে টাকা রোজগারের জন্য স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে রঙিন বেলুন বিক্রি করছে হৃদয়।
কথার ফাঁকে হৃদয় বলল, ‘বাড়িতে ঝামেলা আছে। আর্থিক সংকট, বই-গাইড কিনতে পারিনি। কাম করতাছি, এ কারণে তো স্কুলে যাইতে পারিনি। এ বছর দু–তিন দিন গেছি, তার পর কামে চলে আইছি।’ একটু থেমে হৃদয় আবার বলল, ‘এর আগে কাজকাম করতাম না। শুধু বড় কোনো মেলা হলেই বেলুন নিয়ে যেতাম। বাবা অন্যের খেতে চাষবাস করত। এখন কাজ করতে করতে ক্লান্ত হইয়ে পড়ছে। যাতে আব্বুর একটু উপকার হয়, এ জন্যি কামে আসা। ছোট বাচ্চারা, বড় বাচ্চারা—সবাই পড়তাছে। আমি পড়তে পারতাছি না। সবাই স্কুলে যায়; আমি তাগো কাছে বেলুন বেচি। আফসোস লাগে; কিন্তু করার কিছুই নাই।’
আলাপে আলাপে জানা গেল, হৃদয়ের বাবা বাচ্চু মুন্সী অন্যের খেতে কৃষিশ্রমিকের কাজ করে সংসারের চাকা ঘুরিয়ে চলছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন হৃদয়কে সংসার হাল কিছুটা ধরতে হচ্ছে। হৃদয়রা তিন বোন, ভাই সে একা। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এক দুলাভাইয়ের কাছে থেকে হৃদয় বেলুন বিক্রির কাজ করছে। হৃদয়সহ তার এলাকার আরও চারজন তার দুলাভাইয়ের তত্ত্বাবধানে থেকে এ কাজ করে।
নগরের খালিশপুর পুরান নিউমার্কেট এলাকায় থাকে হৃদয়রা। হৃদয়ের দুলাভাই বছর পাঁচেক ধরে বেলুন বিক্রির ব্যবসা করছেন। ঢাকা থেকে বেলুন কিনে আনেন। খালিশপুরের ভাড়া বাসায় থেকে ফুলিয়ে হৃদয়দের কাছে দেন তিনি। সকাল আটটায় বেলুন নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে রাত আটটায় ফেরে হৃদয়। দুপুরের খাবার বাইরে থেকে সেরে নিতে হয়।
আরও পড়ুন: ‘বাবার পোষা ড্রাগন’ বইটা সবার জন্য না
প্রতিদিন ৭০ থেকে ৭৫টা বেলুন নিয়ে বের হয় হৃদয়। বিক্রি যেগুলো হয় না, তার মধ্য থেকে যদি দুয়েকটা হাওয়া কমে যায়, নতুন রিফিল করে পরের দিন আবার আনে। একেকটার দাম ৫০ টাকা। সাধারণত, বেলা দুইটা পর্যন্ত নেভি স্কুলের সামনে থাকে সে। এরপর নিউমার্কেটে রাত আটটা পর্যন্ত। বেচাকেনা ভালো হলে আগে চলে যেতে পারে। এ বাবদ ৩০০ টাকা করে পায় হৃদয়।
হৃদয় জানায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেলুন বিক্রি করতে হয়। কষ্ট হয়। যেদিন স্কুল বন্ধ থাকে, সেদিন মহল্লায় মহল্লায় যেতে হয়। কখন গ্রামের পথ ধরেও চলে বেচাবিক্রি। যা টাকা রোজগার হয়, সবটাই মাকে পাঠায় হৃদয়।
হৃদয় বলে, ‘বিক্রির জন্য মালিক চাপ দেয় না। তবে ৬০ পিস মাল আনলে যদি ৩০ পিস বেচতে না পারি, মালিকরে তো বুঝ দেওয়া যায় না। তারও তো তখন লাভ থাকে না; নিজের বিবেকের কাছে তখন খারাপ লাগে।’
স্কুলে ফিরা নিয়ে বেশ চিন্তিত মুখে হৃদয় বলে, ‘কিছুদিন পর বাড়ি যাইয়া গাইড কিনা আবার পড়ালেখা শুরু করব। রোজার ভেতর তো মাল চলবে না। ওই সময় বাড়ি চলে যাব। চিন্তাভাবনা করতাছি আর আসব না। বাকিটা দেখি ওপরওয়ালা কী করে!’