প্রায় ৪৮ বছর পর বাকৃবির বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে জয়ী জিল হোসেন

বাকৃবি
জিল হোসেন  © সংগৃহীত

ভগ্নাংশেরও কম নাম্বারের জন্য বেআইনিভাবে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার ৫০ বছর ও মৃত্যুর এক বছর পর হাইকোর্টে ন্যায় বিচার পেলেন জিল হোসেন।

মঙ্গলবার (৭ মার্চ) দুপুরে বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে এ রায় দেন।

এর ফলে ২০০৮ সালে দেয়া রায় অনুযায়ী দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন জিল হোসেনের পরিবার। সেই সাথে ২০০৮ সাল থেকে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বাংলাদেশ কৃৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জিল হোসেনের ন্যায়বিচারের লড়াইটা ছিলো অন্য সবার চেয়ে আলাদা। প্রথমে আদালতের মাধ্যমে স্নাতকের সনদপ্রাপ্তি ও পরে ক্ষতিপূরণ দাবি। অবশেষে ৭২ বছর বয়সে তার মৃত্যুর এক বছর পর বিচারিক আদালতের দেওয়া দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় বহাল রেখেছে হাইকোর্ট।

মঙ্গলবার সকালে বিচারিক আদালতের দেওয়া দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিতেই ধ্বংস হয়েছে জিল হোসেনের জীবন।

এসময় আদালত আরও বলেছেন, জিল হোসেনের স্ত্রী ও তার আট ছেলেমেয়ে এই অর্থ পাবে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস জানান, আপিল করা হবে কিনা সে বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

মামলা থেকে জানা যায়, জিল হোসেন ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের পরীক্ষার্থী ছিলেন। এই পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। কিন্তু ভুল করে মাত্র দশমিক ৫ নম্বর যুক্ত না করায় অকৃতকার্য হন জিল। এই ফল পুনর্বিবেচনার জন্য অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে তিনি আবেদন করলেও কোনো কাজ হয়নি। পরে প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে মামলা করেন তিনি।

এই মামলায় ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত এবং ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে জিলকে অকৃতকার্য করানোকে বেআইনি ঘোষণা করে আদালত। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে জজ আদালতে এবং পরে হাইকোর্টে আপিল করে বসে। হাইকোর্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠায়।

এবারও জিল হোসেনের পক্ষে আসে আদালতের রায়। ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে তার পরীক্ষার ফল প্রকাশের নির্দেশ দেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে রায়ও মানেনি। রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে জেলা জজ আদালত ও পরে হাইকোর্টে আপিল করা হয়।

তবে ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ফল প্রকাশে আগের সিদ্ধান্তকেই বহাল রাখে হাইকোর্ট। এই রায়ের ফলে ১৯৮৬ সালে আবেদন করলে পাস মার্ক দিয়ে জিলকে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর সার্টিফিকেট দেয় বিশ্ববিদ্যালয়।

এই পর্যায়ে ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে ফের আবেদন করেন জিল হোসেন। তার এই আবেদনের শুনানি নিয়ে ২০০৮ সালের ২৬ অক্টোবর রায় দেয় ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে ২ কোটি ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে ২০০৯ সালে এই নির্দেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর দীর্ঘ শুনানি শেষে ১৪ বছর পর মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করল হাইকোর্ট।

কিন্তু দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের শেষটা দেখে যেতে পারলেন না জিল হোসেন। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ৭২ বছর বয়সে মারা যান তিনি।

এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করা হবে না কিনা জানতে চাইলে আইনজীবী মিয়া মো. ইশতিয়াক বলেন, ‘মামলার সিনিয়র আইনজীবী দেশের বাইরে আছেন। তাকে বিষয়টি জানাব। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও জানাব। তারপর তারা করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

হাইকোর্টের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী জিল হোসেনের ছোট ছেলে নুর মোহাম্মদ কিরন। তিনি বলেন, ‘এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট, খুশি। একইসঙ্গে খারাপ লাগছে যে বাবা আজ আর বেঁচে নেই। রায়টি বাবা দেখে যেতে পারলে আরও ভালো লাগতো। এখন আমাদের প্রত্যাশা, আদালতের এই রায় যেন দ্রুত বাস্তবায়ন হয়।’