জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের বিপর্যয়ের ৭৫ তম বার্ষিকী পালনের পক্ষে ভোট দিয়েছে ৯০টি দেশ

বিপর্যয়
১৯৬৭ সালে যুদ্ধ বিজয়ের পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী  © আল জাজিরা

ইহুদিবাদী ইসরাইল ও মার্কিন সরকারের চাপ আর বাধা উপেক্ষা করে জাতিসংঘের বেশিরভাগ সদস্য দেশ এ সংস্থার সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনে দখলদার ইহুদিবাদীদের জাতিগত শুদ্ধি-অভিযান তথা ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয়ের ৭৫ তম বার্ষিকী বা নাকবা দিবস পালন করেছে।

এ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন ৭৭ জাতি গ্রুপ, আরব লিগ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসি, পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ ও জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতিনিধিরা। এইসব আন্তর্জাতিক সংস্থাই মজলুম ফিলিস্তিনি জাতির অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এবং ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য রেখেছে।

জাতিসংঘ মহাসচিবের সহকারী কর্মকর্তা রোজম্যারি ডি কার্লো এই অনুষ্ঠানে বলেছেন, মানবিক সহায়তা বিষয়ক সমন্বয় দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৫ সালের পর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে গত বছরই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ফিলিস্তিনি পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছেন।

ফিলিস্তিনের শহর

ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস শোকাবহ নাকবাহ দিবসের এক ভাষণে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের ঘটনার জন্য রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে মার্কিন ও ব্রিটেন সরকারকে দায়ি করে বলেছেন, এই দুই সরকার তাদের উপনিবেশবাদী লক্ষ্যগুলো হাসিলের জন্য ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডে ইসরাইল নামক সরকার সৃষ্টি করেছে। আর এভাবে তারা ফিলিস্তিনি জাতিকে বলির পাঠা করার কাজে শরিক হয়েছে। তিনি জাতিসংঘ থেকে ইসরাইলকে বহিষ্কারের অথবা জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবগুলো মেনে চলতে ইসরাইলকে বাধ্য করার দাবি জানান। 

জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের বিপর্যয়ের ৭৫ তম বার্ষিকী পালনের পক্ষে ভোট দেয় ৯০টি দেশ এবং বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ৩০টি দেশ, আর ৪৭টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।

১৯৪৮ সালে উদ্বাস্তু হওয়া ফিলিস্তিনি

১৯৪৮ সালের ১৪ মে'র মধ্যরাতে উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ সেনারা তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র ইহুদিবাদীদের কাছে দিয়ে ফিলিস্তিন ত্যাগ করে এবং সেখানে ইহুদিবাদীরা ১৫ মে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেয়। ১৫ মে ব্রিটেনের প্রশিক্ষিত ইহুদিবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো ফিলিস্তিনের শহর ও গ্রামগুলোতে নৃশংস হামলা শুরু করলে মাত্র কয়েক দিনে ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি শহীদ এবং তৎকালীন ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার প্রায় শত্তুর শতাংশ সদস্য তথা সাড়ে নয় লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাই ১৫ মে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক বিপর্যয় দিবস বা শোক দিবস হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে ইহুদিবাদী দখলদাররা ফিলিস্তিনের ৭০০'রও বেশি শহর ও গ্রাম তথা ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক অঞ্চলগুলোর ৮৫ শতাংশেরও বেশি এলাকা দখল করে এবং ৫৩০টিরও বেশি শহর ও গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় যাতে ফিলিস্তিনিরা কখনও দূর ভবিষ্যতে সেখানে ফিরে আসতে পারলেও  বসবাসের কোনো ঘর-বাড়ি না পেয়ে উন্মুক্ত স্থানে থাকতে বাধ্য হয়। ইহুদিবাদীরা সে সময় ৭০টি পৈশাচিক গণহত্যা চালিয়েছিল। কেবল দেড় লাখ ফিলিস্তিনি ফিলিস্তিনে থেকে যেতে সক্ষম হয়। দু হাজার ১৯ সাল নাগাদ এদের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৬ লাখের কাছাকাছি হয়েছে। 

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের মানচিত্র

সে সময় ফিলিস্তিনিরাসহ আরব মুসলিম অঞ্চলর অনেকেই ইসরাইলি দখলদারদের মোকাবেলায় যুদ্ধে জড়িত হন। এই যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার। কয়েকটি আরব দেশের ফিলিস্তিনি নন এমন আরব শহীদদের সংখ্যা ছিল আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার! এ ছাড়াও বন্দি হয় ৫ হাজার যার মধ্যে চার হাজার জন্য ছিলেন ফিলিস্তিনি।   

এ ছাড়াও গত ৭৫ বছরে এক লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি ইহুদিবাদী দখলদারদের সরাসরি গুলিতে শহীদ হয়েছেন এবং দশ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে বন্দি করা হয়েছে। তাই ফিলিস্তিনি সংকট বা নাকবা হচ্ছ গত একশত বছরের ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকট, সবচেয়ে বড় গণহত্যা বা জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ও নৃশংসতম ঘটনা।কেবল তাই নয় মুসলমানদের প্রথম কিবলার দখলদার বর্ণবাদী ইসরাইল গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।

দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে ফিলিস্তিনি অধিবাসীরা-ছবি: সংগৃহীত

অবশ্য ১৯৪৮ সালে প্রায় দশ লাখ ফিলিস্তিনিকে শরণার্থীতে পরিণত করা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে এক কোটি ৪৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, ফলে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করার ইহুদিবাদী ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে গেছে।  আর সাম্প্রতিক সময় ফিলিস্তিনি সংগ্রামী দল ও আরব প্রতিরোধকামী দলগুলোর মোকাবেলায় ইসরাইল অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। গাজার ৫ দিনের সাম্প্রতিক যুদ্ধই এর প্রমাণ। ফলে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ৭৫ তম বার্ষিকী ইসরাইলিরা জাকজমকসহকারে পালনের যে আশা করেছিল তাও সম্ভব হয়নি এ পর্যন্ত। মুসলিম ও আরব বিশ্বে এবং জাতিসংঘেও   ইসরাইল ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। 

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পশ্চিম তীর ও গাজা ছাড়াও কয়েকটি প্রতিবেশী আরব দেশে মোট ৫৮টি শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে ফিলিস্তিনি মুহাজির জনগণ।


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ