মা কে জানাই হাজার সালাম : রাবিপ্রবি উপাচার্য

রাবিপ্রবি
অধ্যাপক ড.সেলিনা আখতার  © ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় "নারীর সম-অধিকার,সম-সুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ"। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়ে কথা বলেছেন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি)  প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ড.সেলিনা আখতার। একজন নারী হিসেবে নারীদের নিয়ে তাঁর চিন্তা ভাবনা এবং তাঁর জীবনের গল্প জানিয়েছেন। নারী দিবস উপলক্ষে বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন "দ্যা বাংলাদেশ মোমেন্ট" এর রাবিপ্রবি প্রতিনিধি সঞ্চিতা চক্রবর্তী। 

দ্যা বাংলাদেশ মোমেন্ট: একজন নারীর সফলতার মূলে কোন অনুষঙ্গগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে? সেক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা কতখানি দরকার বলে আপনি মনে করেন? 

রাবিপ্রবি উপাচার্য :নারী কখনো একা সফলতা অর্জন করতে পারেনা। নারীর সফলতার পিছনে তার মা-বাবা ভাই বোন,আত্মীয় স্বজন এমনকি তার স্বামী-সন্তানদেরও ভূমিকা রাখতে হয়। সব কিছু মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। একজন মানুষের সফলতার পিছনে তার একক কোন শক্তি নয় বরং অনেকগুলো শক্তিমিলিয়েই সে শক্তির অনন্যাতে পৌঁছে যায়। তাই আমি মনে করি সফলতার পিছনে সবার দোয়া,আশীর্বাদ ও সহযোগিতা দরকার।
দ্যা বাংলাদেশ মোমেন্ট :আপনার জন্মস্থান, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া (শিক্ষাগত বিষয়), কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।

রাবিপ্রবি উপাচার্য :আমি রাঙ্গামাটি জেলার চন্দ্রঘোনা নামক স্থানে, চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালে ১৯৭২ সালে জন্মগ্রহণ করি। পড়াশোনা শুরু করি খ্রিষ্টান মিশনারীতে। সেখানে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে কর্ণফুলি পেপারস মিলস হাই-স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছি। সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার উদ্দেশ্যে ঢাকা বদ্দরুন্নেসা মহিলা মহাবিদ্যালয়ে পড়তে যাই। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স  (ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হই)। ১৯৮৪ সালে সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ১৯৮৫ সালে একই বিভাগে মাস্টার্স করি। এরপর কিছু দিন ঢাকায় আইএফআইসি ব্যাংকে কাজ করেছি। সেখান থেকে ১৯৮৮ সালের পহেলা নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছি। সেই থেকে শিক্ষকতা জীবন এখনো চলমান। অবশেষে ২০২২ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেছি ও এখনো দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।

দ্যা বাংলাদেশ মোমেন্ট: আপনার আজকের সফলতার পেছনে কার-কার ভূমিকা রয়েছে? তাদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

রাবিপ্রবি উপাচার্য :আজকে এই অবস্থানে আসার পথে অবশ্যই আমার বাবা-মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আমি যখন পড়ালেখা করেছি তখনতো মেয়েরা সর্বোচ্চ ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পারতো। এরপরে তাঁদের বাবা-মা তাদের বিয়ে দেয়ার জন্য হন্যে হয়ে পাত্র খুঁজতো। সাধারণ শিক্ষিত মানুষ হয়েও আমার বাবা শুধু স্কুল পড়িয়েই সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং আরো শিক্ষিত হতে ঢাকায় পড়াশুনো করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার পরে বিয়ে। কোন দিন তারা এটা চিন্তা করেননি যে আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে এর জন্য আমাকে দ্রুত বিয়ে দিতে হবে। আমরা ৮ ভাই-বোন এক সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। একটা সাধারণ পরিবার থেকে ৮ ভাই-বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় তখনকার সময়ে অন্যান্য পরিবারে তা সম্ভব ছিল না । এক ভাই ডাক্তার তিনি ব্যতীত আমরা ৭ ভাই-বোন সকলেই চবিতে পড়েছি। আমার মা অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী একজন ব্যক্তি। তাঁকে আমি হাজার সালাম জানাই। আমার শিক্ষক, পিএইচডি ডিগ্রি, উপাচার্য হওয়ার পিছনে আমার পরিবারের ভূমিকা অসীম। যদি আমি এই পরিবারে জন্মগ্রহণ না করতাম তাহলে হয়ত আমি এসব কিছুই হতে পারতাম না। আমার মাকে আমি স্যালুট জানাই।

দ্যা বাংলাদেশ মোমেন্ট: আপনার অবসর কীভাবে কাটে, আপনার শখ ইত্যাদি সম্পর্কে যদি বলেন?

রাবিপ্রবি উপাচার্য :অবসর জিনিসটা এখন আমার জীবনে নেই। আগে প্রচুর অবসর পেতাম। তখন এখনকার মতো ব্যস্ত ছিলাম না। অবসরে আমি প্রচুর বই পড়ি। পছন্দের তালিকায় রাজনৈতিক বই, ভ্রমণ কাহিনি, বিভিন্ন মনীষীদের জীবন কাহিনি মূলক বইগুলো। গল্পের বই খুব একটা পড়া হয়না। বড় বড় লেখকের বই গুলো পড়তে ভীষণ পছন্দ করি। পড়াশুনো ছাড়া আসলে আমার ভালো লাগে না। এখন একটা আক্ষেপ খুব কাজ করে, কেন আমি আগে থেকে লিখলাম না? আমার লেখা আমার শিক্ষার্থীরা খুব পছন্দ করে। আসলে এক জীবনে হয়ত সবকিছু একসাথে পাওয়া যায় না।

দ্যা বাংলাদেশ মোমেন্ট: আপনার রাজনীতি ,রাজনৈতিক জীবন ও নানা অর্জন বিষয়ে জানতে চাই।

রাবিপ্রবি উপাচার্য :বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা কাজে আমি জড়িত থাকতাম। অনেকে অনেক চেষ্টা করেও আমাকে থামাতে পারেনি। আমি আলোর পূজারি। আলোর দিকে ছুটে চলি। আমার প্রাণে আলো আছে। এসব রাজনীতির হাতেখড়ি আমি ঢাকায় পড়ার সময় শিখেছি। ঢাকা এমন এক জায়গায় যেখানে নিজেকে তুলে ধরা যায়। ঐ দুই বছরই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যা আমি ঢাকায় থাকতে অর্জন করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে ছাত্রলীগের আলাউদ্দীন-শফি পরিষদ শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলাম। পাশাপাশি শামসুন নাহার হলের ও সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলাম। ঐখান থেকেই রাজনীতি (১৯৮৩-১৯৮৬) পর্যন্ত। ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে ফেলি। শিক্ষক রাজনীতিতে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত ( মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত শিক্ষক সমাজ (হলুদ দল) এর আমি একজন সক্রিয় সিনিয়র নেতা ও সদস্য। সেখান থেকে নমিনেশন পেয়ে ২০০৮ সালে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করি। এর পর আবারো ২০২২ সালে সভাপতি পদে একই গ্রুপ থেকে নির্বাচন করি। ওখানে ১১০০ শিক্ষকের মাঝে নির্বাচন করে প্রতিপক্ষের থেকে প্রায় ১০০ ভোট বেশি পেয়ে জয় লাভ করে সভাপতি হই। আমার মনে হয় শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় বরং বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ এত ভোটে জয় পেয়েছে কিনা আমি জানি না। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে বাংলাদেশে ও চবির প্রথম নারী সভাপতি হিসেবে আমিই প্রথম নির্বাচিত সভাপতি। এটা আমার অপূর্ব বিজয়। এই বিজয় আমি উপভোগ করি। চবিতে নারী শিক্ষক বড়জোড় দুই শত হবে। বাকী ৯০০ শিক্ষক ছিল পুরুষ। বাকী ভোটগুলো কিন্তু পুরুষ শিক্ষক থেকেই পেয়েছি।

দ্যা বাংলাদেশ মোমেন্ট: বিশ্ববিদ্যালয়ে   আপনি রাজনৈতিক ভাবে এত পথ পাড়ি দিয়েছেন সেক্ষেত্রে কোন বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন কি?

রাবিপ্রবি উপাচার্য :কোন মানুষের জীবন কাঁটাবিহীন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে সমান ভাবে যাচাই-বাছাই করেই নেয়া হয়। আমি তেমন কোন বাঁধা পাইনি। তবে আমাদের যে রাজনৈতিক ভাবে যে ঈর্ষা, বৈষম্য এগুলো পেয়েছি। শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আমি কোন অনিয়ম পাইনি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মেয়েরা শিক্ষক রাজনীতি বা দেশের বড় বড় ক্ষেত্রে খুব বেশিদূর যেতে পারেনা কারণ তাদের ডাউনকরে রাখার যত রকম ষড়যন্ত্র আছে তা সব প্রয়োগ করে হয়। আমার উপরেও প্রয়োগ করা হয়েছিলো। আমি মূলত ছাত্রলীগ করা একজন মেয়ে। আমার পরিবারের অনেক অবদান আছে এই দেশের জন্য, এই রাজনীতির জন্য এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।

দ্যা বাংলাদেশ মোমেন্ট: রাজনৈতিক ভাবে এই অবস্থায় আসতে আপনার পরিবার কোন ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন কিনা?

রাবিপ্রবি উপাচার্য :আমার ছোট ভাই আবুল কালাম আজাদ ছিলেন চবি ছাত্রলীগের সহ সভাপতি ও শাহ্জালাল হলের প্রেসিডেন্ট। আমার ভাইয়ের টিউটোরিয়াল পরীক্ষা হচ্ছে সেখান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে। প্রায় মৃত ভেবে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো। ড্রিল মেশিন থেকে শুরু করে বুকের উপরে ইট ও মাথায় আঘাত করা হয় তাকে। শুধু আল্লাহর দয়ায় ও মায়ের দোয়ায় সে বেঁচে যায়। আমার ভাইয়ের উপরে এত নির্যাতন গেছে যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । তার কারণ একটাই সে চবির একছত্র নেতা ও শিবিরের ত্রাস। এতকিছুর পরেও সে শুধু কষ্ট পেয়ে গেছে। বিপদে আসলে তখন কাউকে পাশে পায়নি সে, কেউ এগিয়েও আসেনি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে বার্তা পৌঁছানোর পরেই তিনি তার ভাই বাহাউদ্দীন নাসির কর্তৃক আজাদ ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য এক লক্ষ টাকা অনুদান দেন। সেজন্য আমি ও আমার পরিবার বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে চির কৃতজ্ঞ।

দ্যা বাংলাদেশ মোমেন্ট: নারী দিবস নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

রাবিপ্রবি উপাচার্য : ৮ ই মার্চের ভাবনার তুলনাই হয় না। শিকাগো শহরের সেই সুতার কারখানার মধ্যে যে মহিলা শ্রমিকরা তাদের ১৬ ঘন্টাকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনার যে প্রাণান্তকর চেষ্টা, মাঠে নামা নিয়ে গুলি করে হত্যার মাধ্যমেই কিন্তু এই নারী দিবস জাতিসংঘ স্বীকৃতি পেল। আশ্চর্য বিষয় হলো জাতির পিতা ১৯৭০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে আসছে। ১৯৭১,১৯৭২ সালেও তিনি এই দিবস পালন করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা সব সময় বলেন ছেলে-মেয়ে সমান অধিকার। এখন জনসংখ্যার অর্ধেক মেয়েরা। মেয়েরা পিছিয়ে থাকবে কেন? একজন চবির শিক্ষার্থী হিসেবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, চবির মেয়েরা অনেক কষ্ট করে রাজনীতি করে। তাদের সাথে পদ-পদবীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে বৈষম্য করা হয়। প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে সমান চেষ্টা করলেও মেয়েরা উপযুক্ত পদ-পদবি পায়না। যেমন আমি পাইনি। আমি দুই-তিনবার নমিনেশন চেয়েও আমার দল আমাকে দেয়নি। আমি চাই মেয়েরা এগিয়ে যাক, তারা এগিয়ে গেলেই দেশ এগিয়ে যাবে।


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ