প্রকৃতি ধ্বংস করে কি স্মার্ট ঢাকা গড়া সম্ভব?

ঢাকা
  © সংগৃহীত

মেগা সিটি ঢাকা। ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ শহর দেশের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্রবিন্দু। এর পরিসর আরও বাড়াতে দিনকে দিন ঢাকার বুকে গড়ে উঠছে মেগা প্রকল্প, এক্সপ্রেসওয়ে ও উড়াল সেতুসহ নানা স্থাপনা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর নামে প্রকৃতি হত্যায় চলছে এক মহাধ্বংসযজ্ঞ। তাইতো প্রশ্ন ওঠেছে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে কি সম্ভব একে স্মার্ট নগরীতে রূপান্তর?

ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এবার স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন দেশের মানুষ। আবার স্মার্ট বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে উঠবে -- এ আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন এর বাসিন্দারা। নগরবাসীর এ স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই একে একে বাস্তবায়ন হচ্ছে নানা উন্নয়ন প্রকল্প।

আর এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নির্মমভাবে চলছে প্রকৃতি হত্যার কাজ। সবুজকে ধ্বংস করে, জলাধার ভরাট করে, গাছ কেটে এবং পার্ক দখল করে চলছে মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন। নগরবাসী এখন খোলা আকাশ দেখেন না, আকাশের দিকে তাকালে তারা দেখতে পান উঁচু দালান, মেট্রোরেল, উড়াল সেতু, আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
 
নেই সবুজ, ভরাট হচ্ছে জলাধার
ঢাকায় নেই সবুজায়ন, আছে নানা রকমের দূষণ। কখনো তীব্র গরম, আবার কখনো সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা নগরবাসীর সাধারণ অভিজ্ঞতা। রাজউকের করা ড্যাপের ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে স্থাপনা ও কংক্রিট আচ্ছাদিত স্থান থাকার কথা ৪০ শতাংশ, রয়েছে ৮২ শতাংশ। সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত জায়গা থাকার কথা ৬০ শতাংশ, রয়েছে মাত্র ২৪ শতাংশ। প্রতি একরে বসবাস করার কথা ১০০ থেকে ১২০ জন; বিপরীতে বসবাস করছেন ৪০০ থেকে ৫০০ জন।
 
বায়ুমানেও খারাপ অবস্থান ঢাকার
ব্যাপক এ প্রতিকূলতার চাপ বাড়ছে সবুজায়ন ও জলাধার তথা প্রকৃতির ওপর। এতে একদিকে হচ্ছে বায়ুদূষণ, অন্যদিকে তীব্র তাপপ্রবাহে নাভিশ্বাস উঠছে নগরবাসীর। আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের মানদণ্ডে প্রায় প্রতি নিয়তই বায়ুদূষণে শীর্ষ অবস্থানে থাকছে ঢাকা। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বায়ুমান সূচকে ঢাকার গড় নম্বর (স্কোর) ছিল ১৭১, যা আগের বছর ছিল ১৬৩।
 
বায়ুমান সূচকে নম্বর ১৫১ থেকে ২০০-এর মধ্যে হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু হিসেবে গণ্য হয়। নম্বর যত বেশি হবে, মান তত খারাপ।
 
রেকর্ড তাপপ্রবাহ
গত ২৯ এপ্রিল ঢাকায় চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ছিল তখন পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৮ বছরের মধ্যে রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

এর আগে, ১৯৬৫ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রসঙ্গত, এখন পর্যন্ত ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল, ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশব্যাপী চলমান তাপপ্রবাহ নাভিশ্বাস তুলেছে জনজীবনে। ব্যারোমিটারের পারদে চলতি গরমে ঢাকা এখনো শীর্ষস্থানে না গেলেও তাপের অনুভূতি মোটেই কম নয়।
 
গত ২০ বছরে ঢাকার গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি। তাপমাত্রা বাড়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগর পরিচালনা ও সেবাদানে যুক্ত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বা ঘাটতি।
 
এ অবস্থায় যতই শীতলীকরণ যন্ত্র এসি ব্যবহার করা হয় না কেন, তাতে তাপপ্রবাহ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসবে না। বরং এ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রই নগরবাসীর বসবাসের ক্ষেত্রে বুমেরাং হয়ে উঠবে।
 
তবু কি সম্ভব স্মার্ট ঢাকা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয়- এ তিন কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে। ঢাকার প্রকৃতির যে অবস্থা, তাতে ঢাকায় শ্বাস নেয়াও দুষ্কর হয়ে উঠছে। প্রকৃতির এমন দুর্দশায় কীভাবে সম্ভব ঢাকাকে স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তোলা? এ সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।
 
তিনি বলেন, ঢাকার প্রকৃতি বিপন্ন। ঢাকায় যে জীববৈচিত্র্য ছিল, সেটা আমরা বিগত বছরগুলোতে ধ্বংস করে দিয়েছি। সম্প্রতি ঢাকায় ব্যাপক নগরায়ণ হয়েছে, কিন্তু এর কারণে জলাধার ধ্বংস হয়েছে, খেলাধুলার মাঠ ধ্বংস হয়েছে এবং ফুরিয়েছে সবুজ। বর্তমানে যে ছিটেফোঁটা সবুজ আছে, সেওতো ধ্বংসের মুখে!
  
এ অধ্যাপকের মতে, ‘মেগাপ্রকল্পের নাম দিয়ে বিভিন্ন পার্ক আমরা বন্ধ করে রেখেছি, সবুজ এলাকা আমরা ধ্বংস করেছি। যেমন খুব সম্প্রতি আমরা দেখলাম, আনোয়ারা উদ্যানটাকে বন্ধ করে দিয়ে আমরা মেট্রোরেলের স্টেশন করতে চাচ্ছি। মেগাপ্রকল্প অবশ্যই হবে; কিন্তু সেজন্য সবুজকে ধ্বংস নয়।
 
‘অনেক দেশ আমরা দেখেছি, যেখানে কিন্তু ৩০ শতাংশ সবুজ রেখে মেগা প্রকল্প করা হয়েছে। আর ঢাকার সবুজ কমতে কমতে ৯ শতাংশের কমে চলে এসেছে, আর জলাধার কমতে কমতে ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রকৃতির সঙ্গে ঢাকার ব্যালেন্সটা একদমই নষ্ট হয়ে গেছে। যে মেগাপ্রকল্পগুলো চলছে এবং সামনেও যেসব প্রকল্প নেয়া হবে বা হচ্ছে সেসব মেগা প্রকল্পের কারণে প্রকৃতি একদম বিপন্নের পথে। বিশেষ করে সবুজ, জলাধার এবং কংক্রিটের যে ব্যালেন্স, সেটা কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেছে। এ কারণে ঢাকায় এখন বিনোদনের জায়গার অভাব, পার্কের জায়গা নেই, বাচ্চাদের খেলাধুলার কোনো স্থান নাই। ঢাকা শহরে মুক্ত অঙ্গনে শ্বাস নেয়ার জায়গা নেই। এজন্য বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের মাত্রা এত বেশি।’
 
প্রকৃতিকে ধ্বংস করে পৃথিবীর কোথাও কোনো মেগা প্রকল্প হয় না জানিয়ে এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘মৌলিক জায়গা ধ্বংস করে দিয়ে গড়ে তোলা স্মার্ট নগর আমাদের কোনো কাজে আসবে না। সবুজ এবং জলাধার আমাদের তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদের বায়ুদূষণ প্রতিহত করে। কিন্তু সবকিছু ভুলে গিয়ে মেগাপ্রকল্পের নামে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে, প্রকৃতি তা স্বাভাবিকভাবে নেবে না। 
 
‘গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের নামে আমরা সবুজকে ধ্বংস করেছি, হাতিরঝিলের মতো এলাকার একাংশ আমরা ভরাট করেছি। কোনো ধরনের প্ল্যানিং ছাড়া একের পর এক মেগাপ্রকল্প করা হচ্ছে। কোনো প্রকল্প করার সময় সিটি করপোরেশন বা রাজউক কারো কাছে এসে প্রকল্প শেয়ার করে না। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে পৃথিবীর কোথাও কোনো মেগাপ্রকল্প হয় না; আমাদের দেশেও হওয়া উচিত না। কিন্তু হচ্ছে।’
 
প্রকৃতিকে ধ্বংস করে কখনো স্মার্ট সিটি নির্মাণ করা সম্ভব না জানিয়ে অধ্যাপক আদিল বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ইনভেস্টমেন্ট ঢাকাতেই হয়। তবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে স্মার্ট সিটি নির্মাণ করা সম্ভব না। ঢাকায় এখন প্রয়োজন ডেভেলপমেন্ট কন্ট্রোল। অথচ উল্টো আরও ডেভেলপমেন্ট করা হচ্ছে, সেখানে প্রকৃতি বিপন্ন হয়ে উঠছে।
 
তিনি বলেন, প্রকৃতিকে রক্ষা করে ঢাকাকে স্মার্ট বানানো সম্ভব; তবে অনেক কঠিন। প্রকৃতিকে আমরা নষ্টই করে ফেলেছি। যতটুকু সবুজ আছে, এখনো যতটুকু জলাধার আছে, এগুলোকে যদি পুরোপুরি রক্ষা করা যায়, তাকে যদি বাড়ানো যায় এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ থামানো গেলে ঢাকা হতে পারে স্মার্ট সিটি।