শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে কে বসবে- ভারত না অস্ট্রেলিয়া

বিশ্বকাপ
  © ফাইল ছবি

ভারতে দীপাবলির লম্বা ছুটি শেষ হওয়ার পথে। অক্টোবরের শুরু থেকেই যে বিভিন্ন উৎসব দেশজুড়ে, বলা হয় উৎসবের মৌসুম, সেটিও শেষ হলো বলে। তবে গোটা দেশের সবচেয়ে বড় ধর্ম বলা হয় যেটিকে, সেই ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় উৎসব কেবল শুরু হওয়ার অপেক্ষায়! যদিও গত দেড় মাস ধরে ভারতে চলছে বিশ্বকাপ এবং তা এখন পৌঁছে গেছে শিষ ঠিকানায়। তবে আসল উৎসব তো হবে ভারত শিরোপা জিতলে! আহমেদাবাদে সাবারমাতি নদীর তীরে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম থেকে সেই উচ্ছ্বাসের ঢেউ এখন গোটা ভারতে বয়ে যাওয়ার অপেক্ষা।

গোটা ভারতের সেই উৎসবের আয়োজনকে ম্লান করে দেওয়ার মতো কোনো দল যদি থাকে, ফাইনালে তারাই প্রতিপক্ষ। আবেগ যাদেরকে খুব বেশি স্পর্শ করে না, পারিপার্শ্বিকতা কিংবা প্রতিবন্ধকতা তাদের কাবু করে না। ট্রফির সুবাস পেলে যারা আরও বুনো হয়ে ওঠে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সফলতম দল, বড় মঞ্চের বড় দল অস্ট্রেলিয়াও প্রস্তুত ভারতকে হতাশায় ডুবিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের নতুন সোপানে পা রাখতে।

৪৫ দিন আগে যে মাঠে শুরু হয়েছিল ১০ দলের ক্রিকেটযুদ্ধ, সেই একই আঙিনায় এখন শেষের মহারণের অপেক্ষা। ওয়ানডে ক্রিকেটের ত্রয়োদশ বিশ্ব আসরের ফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। এই আসরের অপ্রতিরোধ্য দলের সঙ্গে বিশ্বকাপের পরাক্রমশালী দলের লড়াই শুরু বাংলাদেশ সময় রোববার দুপুর আড়াইটায়।

ফাইনালের মতো লড়াইয়ে ফেভারিট বলে কিছু এমনিতে থাকে না। তবে এবারের আসরে ভারত যেভাবে খেলেছে, শুরু থেকেই দাপট দেখিয়ে একের পর এক প্রতিপক্ষকে যেভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং টানা ১০ জয়ে পৌঁছে গেছে শেষের মঞ্চে, তাদেরকে এগিয়ে রাখতে চাইবেন হয়তো অনেকেই। চেনা মাঠ আর কন্ডিশনের সঙ্গে দর্শকের প্রবল সমর্থন তো আছেই!

যে মাঠে ফাইনাল হচ্ছে, দর্শক ধারণ ক্ষমতার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম এটি। ১ লাখ ৩২ হাজার আসনের মাঠে রোববার গ্যালারি পরিপূর্ণ থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক প্যাট কামিন্স ম্যাচের আগের দিনই বলে দিয়েছেন, ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকই গলা ফাটাবেন ভারতের পক্ষে। প্রতিপক্ষকে ভড়কে দিতে আর কী লাগে!

কিন্তু এই দলটা তো অস্ট্রেলিয়া। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তারা। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের চিরায়ত রক্ত প্রবাহিত হয় তাদের শিরায়। কামিন্স তাই মুচকি হাসিতে বলেছেন, “দর্শক সমর্থন অবশ্যই ভীষণরকমের একতরফা থাকবে। বিশাল সংখ্যক দর্শককে চুপ করিয়ে দিতে পারার চেয়ে তৃপ্তিদায়ক কিছু খেলাধুলায় আর নেই!”

ক্রিকেটের দিক থেকে এই বিশ্বকাপের ভারত একরকম দুর্দমনীয়। আর কোনো ভারতীয় দল কখনও এতটা দাপুটে ক্রিকেট খেলেছে কি না, এই প্রশ্ন তো নিয়মিতই উঠছে। স্রেফ একজন ভালো ষষ্ঠ বোলারের ঘাটতি ছাড়া আর কোনো দুর্বলতা এই দলের নেই বললেই চলে।

ব্যাটিং লাইন আপের প্রথম পাঁচজনই আছেন দুর্দান্ত ফর্মে এবং নিজেদের ভূমিকা তারা পালন করে চলেছেন সুনিপুণভাবে। প্রায় প্রতি ম্যাচেই উড়ন্ত সূচনা এনে দিচ্ছেন রোহিত শার্মা, পরিস্থিতি বুঝে খেলছেন শুবমান গিল, ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড হয়ে আছেন ভিরাট কোহলি। শ্রেয়াস আইয়ার ও লোকেশ রাহুলও নিজেদের সেরাটা মেলে ধরছেন প্রয়োজনের সময়।

তাদের বোলিং আক্রমণও নিঃসন্দেহে বিশ্বকাপের সেরা। জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ সিরাজ ও মোহাম্মদ শামিকে নিয়ে গড়া পেস আক্রমণ প্রতিপক্ষের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়েছে ম্যাচের পর ম্যাচ। রবীন্দ্র জাদেজা ও কুলদিপ ইয়াদাভকে গিয়ে গড়া স্পিন আক্রমণ দারুণ ক্ষুরধার ও কার্যকর।

তাদের জন্য আপাত চোখে মূল বাধা- প্রত্যাশার প্রবল চাপ আর অস্ট্রেলিয়ার চ্যাম্পিয়ন সত্ত্বা জেগে ওঠা। ফাইনালের আগের দিন রোহিত শার্মার ৩৪ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে বারবার ঘুরেফিরে প্রত্যাশার চাপের কথাই এলো। ভারতীয় অধিনায়ক বারবারই বললেন যে, তিনি ও তার দল বেশ স্থির, শান্ত ও ফুরফুরে আছেন। বারংবার প্রশ্নে তিনি এক পর্যায়ে বললেন, “ মাঠে গিয়েই দেখুন ক্রিকেটারদের সবাইকে। প্রতিটি ম্যাচের আগেই আমরা খুবই গোছানো ও স্থির থেকেছি। এই ম্যাচের আগেও তেমনই আছি।”

ভারতীয় দল আহমেদাবাদে আসার পর দুই দিন ধরেই স্টেডিয়ামের পাশে দিন-রাত স্লোগানের পর স্লোগান চলছে। শত শত লোক ভীড় করছে। সবাই ট্রফির স্বপ্নে বিভোর। দেশজুড়েও যে উত্তেজনা, সেটির আঁচ যে গায়ে লাগছে, তা অস্বীকার করলেন না রোহিত।

“ইমোশনালি, অবশ্যই এটা বড় ব্যাপার, বড় উপলক্ষ। কোনো সংশয় নেই। যতটা কঠোর পরিশ্রম, যত স্বপ্ন, সব এই দিনকে ঘিরেই। কালকে সেই দিনটি আমাদের সামনে আসছে। তবে পেশাদার অ্যাথলেটদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জই তো এটা যে, কীভাবে সবকিছু এক পাশে সরিয়ে মূল কাজে মনোযোগ দিতে পারে। আমার সঙ্গে আরও ১০ ক্রিকেটার কাল তাই মাঠে নামবে নিজেদের কাজে মন দিতে, জীবনের সেরা মুহূর্ত হিসেবে তারা ভাববে না।”

“হ্যাঁ, এটায় কোনো সন্দেহ নেই যে, মনের কোণে ভাবনাটা থাকবেই যে ফাইনাল ম্যাচ। এখানে লুকোচুরির কিছু নেই। তবে এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্থির ও গোছানো থাকা জরুরি, যেন দল হিসেবে ভালো করা যায় এবং চাপের মধ্য সেরা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।”

চাপ সামলানোর জায়গাতেই অনেকটা এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া। প্রথমত, মাঠের লাখো দর্শক বা দেশের দেড়শ কোটিং মানুষের প্রত্যাশার চাপ তাদের নেই। দ্বিতীয়ত, বড় ম্যাচ বা ফাইনালের চাপ সামলাতে তারা জানে ভালোভাবেই। পাঁচটি বিশ্বকাপজয়ী দল বলে কথা!

অবশ্যই এই দলের ক্রিকেটাররা অতগুলো বিশ্বকাপ জেতেননি। তবে ২০১৫ বিশ্বকাপ, ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও এই বছর আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী ক্রিকেটার এই দলের প্রায় সবাই। ফাইনালের আগের দিন সেটিই মনে করিয়ে দিলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক কামিন্স।

“আমার মনে হয়, ম্যাচটিতে লড়াই হবে সমানে সমান। দুই দলের পক্ষেই নানা কিছু বলা যায়। ভালো ব্যাপার হলো, ২০১৫ বিশ্বকাপজয়ী দলের ৬-৭ জন ক্রিকেটার আছে এই দলে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী দলের আরও অনেক বেশি আছে। ১৫ জনের ১২ জনই বোধহয় বিশ্বকাপ জিতেছে। কাজেই তারা এই স্বাদটা জানে এবং এটাও জানে যে, এসব ম্যাচে কী করতে হয়। তারা তাই ভড়কে যাবে না এবং দাপট দেখাতে সাহসী হবে।”

ভারতের মতো টানা ১০ ম্যাচ না জিতলেও তারা জিতেছে টানা ৮টি। কিছু ম্যাচ এতটা কঠিন পরিস্থিতি থেকে জিতেছে, প্রবল আত্মবিশ্বাস তাই তাদের সঙ্গী হতেই পারে যে, কোনো অবস্থায় তারা হারবে না!

ভারতের একাদশ অপরিবর্তিত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অস্ট্রেলিয়া দলে মার্নাস লাবুশেনের জায়গায় আসত পারেন মার্কাস স্টয়নিস।

সবশেষ কিছু বিশ্বকাপের সমীকরণ মানলে, শিরোপার ফয়সালা হতে পারে টসেই। সবশেষ তিনটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও চারটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে যে পরে ব্যাট করা দল!

ওসব নাহয় অতীত বলে বাদ দেওয়া গেল। এবারের বিশ্বকাপে এই মাঠে চার ম্যাচের তিনটিতেই জিতেছে পরে ব্যাট করা দল। এমনকি সবশেষ দুটি আইপিএলের ফাইনালেও এখানে জিতেছে পরে ব্যাট করা দল।

তবে সবকিছু তো আর এতটা সহজ সূত্র মেনে চলে না! ক্রিকেটীয় লড়াই, বিশেষ করে ফাইনালে লড়াইয়ের ভেতর থাকে ছোট ছোট অনেক লড়াই। সেসব লড়াইয়ে যারা জিতবে, ট্রফিও তাদেরই হবে।

রোহিত শার্মারা এখন ছক কষছেন সেসব লড়াই জিতে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের। কামিন্সরা স্বপ্নের তুলিতে আঁকছেন, দেশে ফেরার বিমানে তাতের সঙ্গী ওই সোনালী ট্রফি। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ট্রফি কেসে যে ট্রফির সংখ্যা হবে ৬টি!


মন্তব্য