জবির গুচ্ছ ভাস্কর্য একইসাথে অনুপ্রেরণা ও বেদনার

জবি
  © মোমেন্টস ফটো

"একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি " নিয়ে নির্মিত দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্যটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। ভাস্কর রাসা  মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নির্মাণ করেন এই ভাস্কর্যটি। এই ভাস্কর্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। 

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষদের জোর করে ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়) ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হতাে। হত্যার পর লাশের স্তুপ সাজিয়ে গণকবর দেয়া হতাে বর্তমান এই ভাস্কর্যটির নিচে।

ভাস্কর্যটির দুটি অংশ রয়েছে। প্রথমটি হল একাত্তরের গণহত্যার চিত্র অপরটি হল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির চিত্র। একাত্তরের গণহত্যা অংশ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ২৯ টি  ফিগার নিয়ে গঠিত এই অংশ। আরো দেখা যায়, নির্বিচারে নিরস্ত্র বাঙালিদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে মায়ের কোল থেকে তার সন্তানকে।  আত্মসাৎ করে হত্যা করা হচ্ছে বাংলার মা-বোনদের চরিত্র।  এসব যেন পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে এক নগণ্য বিষয়।

পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হাট-বাজার, গ্রাম-গঞ্জ। গর্ভবতী মায়ের লাশ পড়ে আছে পাশেই, নিষ্পাপ শিশুটি হানাদার বাহিনীর বিষাক্ত ছোবলের শিকার। ইয়াহিয়া খান মাতাল হয়ে আছেন সে রাতে, তিনি যেন আনন্দে আত্মহারা। 

স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা বাঙালির লাশ যেন রূপকথাকেও হার মানায়। ভাস্কর্যের একপাশে পত্র শূন্য বৃক্ষে একটি শকুনকে লক্ষ্য করা যায় যা মূলত একাত্তরে বাংলার রূপকে সংজ্ঞায়িত করে। 

অপরদিকে, ১৯ টি ফিগার নিয়ে গঠিত মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি অংশে দেখা যায়,  বঙ্গবন্ধু  বলছেন ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা এগিয়ে এসেছেন  বটি, বর্ষা, বল্লম ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে।

পরে সময়ের প্রয়োজনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রকে মোকাবেলা করতে তৎকালীন বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র- স্টেনগান, মেশিনগান, রাইফেল ইত্যাদি নিয়ে বাংলার সাধারণ জনতা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে গড়ে ওঠেন দক্ষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। আর প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ তো আছেই। 

এ যুদ্ধ শুধুমাত্র তরুণ-যুবকদের অংশগ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং অংশ নিয়েছিলেন অসংখ্য কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, প্রবীণ ব্যক্তি ও লক্ষ লক্ষ জনতা। বাদ যায়নি বাংলার মা বোনেরা। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে এসেছেন দেশ মাতৃকাকে রক্ষা করতে।

 ভাস্কর্যে ফিল্ড মেডিকেল এর অংশ হিসেবে একজন নারী ডাক্তার কেউ দেখা যায়। ভাস্কর্যকে পরিবেষ্টন করে আছে পানি যা নদীমাতৃক বাংলাদেশকে চিহ্নিত করে। এবং পানির নিচের বাংলা বর্ণমালা গুলো ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ইঙ্গিত করে।

অসম্পূর্ণ এই ভাস্কর্যের বাকি অংশ গুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে ভাস্কর রাসা জানান, এই ভাস্কর্যটির পাঁচটি অংশ, যার তিনটি অংশ অসম্পূর্ণ রয়েছে । এগুলো হলো ঘাতক, মুক্তিযােদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ এবং বিজয়। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান আমাকে ভাস্কর্যের বাকি অংশের কাজ স্থগিত রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসে এই বাকি তিনটি অংশের কাজ করা হবে।

তিনি আরো জানান, বাকি তিনটি অংশের মডেল তৈরিতে নূন্যতম ছয় মাস এবং ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণ কার্যক্রম শেষ করতে আরো ছয় বছর সময় লাগবে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য জনাব ইমদাদুল হক অতি শীগ্রই তাঁকে আহ্বান করবেন পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করার জন্য। তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। জনাব ইমদাদুল হক স্যার সম্মতি জানালে তিনি এখন থেকেই ভাস্কর্যের মডেল নির্মাণ এবং পরবর্তী বছর এর প্রথম সপ্তাহ থেকেই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

তিনি মনে করেন, পরিকল্পিতভাবে ২০২৪ সালের শুরু থেকে কার্যক্রমটি শুরু করলে ২০৩০ সাল নাগাদ ভাস্কর্যের কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হবে। বাকি তিনটি ভাস্করের জন্য ৬০ থেকে ৮০টি ফিগার প্রয়োজন হবে বলে তিনি জানান। সর্বোপরি, ভাস্কর রাসার অসম্পূর্ণ এই সৃষ্টি সত্যিই এক অমর কীর্তি যা প্রতিনিয়ত আমাদের আমাদের শেকর ও আমাদের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।


মন্তব্য