থামছেই না আত্মহত্যা,চবিতে এক যুগে ঝরলো ১৯ প্রাণ
- সারওয়ার মাহমুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
- প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৩, ১০:০৭ AM , আপডেট: ২০ জুন ২০২৩, ১০:০৭ AM

আত্মহত্যার মানে কী? সহজ বাংলায় নিজেকে মেরে ফেলা, একেবারে জানে মেরে ফেলা। পৃথিবী থেকে নিষ্ঠুরভাবে বিদায় নিয়ে নেওয়া, একজন জীবন্ত, জলজ্যান্ত মানুষ নিজেকে চিরতরে শেষ করে দেয়া। হাজারো সাজানো স্বপ্নকে নিজ হাতে ধ্বংস করে বিরক্ত, তিক্ত পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করা।তবে এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই দেশের তুলনামূলক সবচেয়ে মেধাবী এবং সচেতন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। যারা গড়ে তুলবে সোনার বাংলাদেশ তারাই বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
একটি বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৭৯ জন।বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে, যা ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা ৬২ জন।২০২২ সালে এবং তার পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও তার ব্যতিক্রম নয় ক্রমেই বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা। চবিতে গত এক যুগে ছাত্র -শিক্ষক মিলিয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে উনিশ জনে।
গতকাল রাতে (১৯ জুন) ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সামি চৌধুরী আত্মহত্যা করেছে। চট্টগ্রাম শহরের একে খান এলাকায় একটি বাসায় তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে সহপাঠীরা। পরবর্তীতে মরদেহ টি চমেকে রাখা হয় তবে এখনো আত্মহত্যার মূল কারণ উদঘাটন সম্ভব হয় নি।
গত ২৫ শে মে তেলাপোকা মারার ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে চবির ইতিহাস বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী।নাম প্রকাশ্যে না আসলেও তার বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলায় বলে তথ্য পাওয়া যায়।
এর আগে চলতি বছরের ৮ ই এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের ২১০ নং কক্ষে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী রোকেয়া খাতুন (রুকু)। আত্মহত্যার মূল কারণ অস্পষ্ট থাকলেও স্বামী কর্তৃক মানসিক নির্যাতন, গর্ভপাত এবং পরীক্ষা দিতে না পারার অভিযোগ সামনে আসে। দুই মাসের ব্যবধানে আত্মহত্যা করে তিন জন শিক্ষার্থী।
২০০৮ সালে লোকপ্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সাইফুল ইসলামের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছর আত্মহত্যা করেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অ্যান্ড্রু অলক দেওয়ারি। এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আত্মহত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর দিদারুল আলম চৌধুরীসহ ৮ জন। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোনো ছাত্র-শিক্ষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০১৭ সাল থেকে আবার বাড়তে শুরু করে আত্মহত্যার প্রবণতা। ওই বছরের ৭ মার্চ ফ্যানে ঝুলন্ত বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।২০২২ সালে শাহজালাল হলের বিপরীতে কটেজে শিক্ষার্থী অনিকের ৬ পৃষ্ঠা চিরকুট লিখে রহস্য জনক ভাবে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে । উল্লেখযোগ্য ঘটনা গুলো ছাড়াও আরো কয়েকজন আত্মহত্যা করে কিংবা বিভিন্ন সময়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে।
নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য কারন:
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের আত্মহত্যার বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হুট করেই তাঁরা জীবনের ইতি টানছেন। কারণ খুঁজতে গিয়ে কোথাও ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, কোথাওবা জীবন-জীবিকার সংকট সামনে আসছে, মাদকাসক্তি, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে একাডেমিক ফলাফল আশানুরূপ না হওয়া,কাম্য যোগ্যতা অর্জন করেও কর্মস্থল না পাওয়া ইত্যাদি।
মনোবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী, চাওয়ার সঙ্গে না পাওয়ার দ্বন্দ্ব, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, রোগ-বালাইয়ের জের থেকে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই অনেক সময়ই মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। সেই চাপ থেকেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আত্মহত্যা থেকে শিক্ষার্থীদের বিরত রাখতে প্রতি বিভাগে মাসে অন্তত একবার হলেও কাউন্সেলিং করা উচিত। পরিবারকেও নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে। পাশাপাশি পরিবার থেকে নৈতিকতা, ধর্মীয় চর্চার প্রসার, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় আড্ডা দিচ্ছে এসব তদারকি করা দরকার।
চবিতে নেই কোনো মনোবিদ, অকার্যকর কাউন্সিলিং সেবা:
১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬ বছর পার করলেও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়োগ দেয়নি কোনো Psychiatrist (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ)।এতে মাদকাসক্ত, মানসিক অবসাদ বা হতাশা গ্রস্থ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর এই বৃহৎ বিদ্যাপীঠে যেখানে কয়েকজন মনোবিদ থাকার কথা সেখানে একজনও নেই।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিং সেবা চালু করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রকোপ শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় এই সেবা। এর আগে এই সেন্টারে সেবা নেন শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। পুনরায় মনোবিদ নিয়োগ দিয়ে এই সেবা চালু করা অতীব জরুরি।
অবশ্য গত ৪ ই জুন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতি তে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড.শিরীন আখতার চবি মেডিকেল সেন্টারে পুনরায় কাউন্সিলিং সেবা চালু হওয়ার আশ্বাস জানান। তিনি বলেন -"আমি দেখছি আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেকই হতাশায় ভোগে,ট্রমায় চলে যায়। সম্প্রতি আমাদের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করার পরে সাইকোলজি বিভাগ কে আমাদের মেডিকেল সেন্টারে আগে যেই কাউন্সিলিং করা হতো তা পুনরায় চালু করার অনুমতি দিয়েছি। ভবিষ্যতে হল গুলো তে এই সেবা চালু করা হবে"।
ছাত্র- শিক্ষক সম্পর্ক:ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মানোন্নয়ন করতে হবে, এতে কোনো শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে শিক্ষকেরা সহজেই বুঝতে পারবেন এবং হতাশা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। কোনো শিক্ষক যেন কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ না হন, শিক্ষকেরা যেন হন শিক্ষার্থীদের সব থেকে বড় আশ্রয়, স্বপ্ন গড়ার কারিগর।