মজুরি বৈষম্যের শিকার ঈশ্বরদীর লিচুকন্যারা

ঈশ্বরদী
  © টিবিএম ফটো

লিচুর রাজধানী হিসাবে খ্যাত পাবনার ঈশ্বরদীতে পুরোদমে শুরু হয়েছে লিচু ভাঙ্গা, বাছাই ও বাজারজাতকরনের কাজ। আর এসব কাজের সাথে প্রত্যহভাবে জড়িত গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার নারী। লিচু পাকার পর বাছাই ও গণনার কাজ নারী শ্রমিকরাই করেন। এদের কেউ  গৃহিণী, দিনমজুর, স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিভিন্ন বাগানে কর্মরত এই নারীরা ঈশ্বরদীতে লিচুকন্যা নামে পরিচিত। তীব্র গড়মে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও লিচুকন্যরা ন্যায্য মজুরি পান না। সময় নষ্ট না করে পুরুষের তুলনায় ২০০-৩০০ টাকা কম মজুরিতেই  তারা কাজ করেন। দীর্ঘদিন ধরে এসব লিচুকন্যারা মজুরি বৈষম্যের শিকার।

মধুমাস আসলে প্রতি বছরই আলোচনায় আসে বোম্বাই লিচুর রাজধানী বলে খ্যাত ঈশ্বরদী। এখানকার রসালো লিচুর কদর দেশজুড়ে। ফলপ্রেমীদের বরাবরই আগ্রহ থাকে ঈশ্বরদীর রসালো লিচুর দিকে। ঈশ্বরদীতে এবারে ৩,১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লিচু গাছে কাঙ্খিত মুকুল আসেনি। মাত্র ৪০-৫০ ভাগ গাছে বোম্বাই লিচুর মুকুল আসলেও এরইমধ্যে বিরাজমান ছিল দাবদাহ। তাপমাত্রা ৩৮-৪৩ ডিগ্রীতে উঠানামা করেছে। টানা তাপদাহে লিচু পরিপক্ক হয়ে উঠার আগেই লালচে রং ধারণ করে। এরইমধ্যে গাছেই ফেটে ঝরে পড়েছে অনেক লিচু।

সরেজমিনে লিচু বাগানগুলো ঘুরে দেখা যায়, বোম্বাই লিচু পরিপক্ক হয়ে লালচে রং ধারণ করেছে। প্রতিটি বাগানেই কাজে নেমেছেন নারী শ্রমিকরা। লিচু উৎপাদন, পরিচর্যা ও বিপণনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নারী কর্মীরা। অনেকটা অন্তরালে থেকে যান লিচু উৎপাদনের সাথে জড়িত লিচুকন্যারা। লিচুকন্যাদের সাথে সাথে বাগানমালিক ও চাষিদের পরিবারের বৌ-ঝিসহ নারী সদস্যরাও লিচু বাছাই ও গণনার কাজে অংশ নেন।

মানিকনগর গ্রামের চর কদিমপুর এলাকার লিচু বাগানের মালিক শামিম  হোসেন বলেন, প্রায় ৩০ হাজার নারী প্রত্যহভাবে লিচুর বাগানে নানান কাজের সাথে জড়িত। কেউ  গৃহিণী, দিনমজুর, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মধ্যে বিভিন্ন বাগানে কাজ করেন। দিন শেষে দুই বেলা খাওয়া এবং ৩০০-৪০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। তবে ৬০০-৭০০ টাকার কমে পুরুষ শ্রমিকরা কাজে আসেন না।

উপজেলার জয়নগর এলাকার লিচু চাষী খাইরুল বাসার মিঠু বলেন, নারীদের চেয়ে বেশি শক্তির কাজ করেন পুরুষ। তাদের কাজের গতিও বেশি থাকে। এ জন্য তাঁদের মজুরি বেশি দিতে হয়। আর নারীরা পুরুষের মতো কাজ করতে পারেন না। তারপরও এঁদের কাজ দিতে হয়। বাগানে লিচু বাছাই ও গননার কাজ করতে অবসরে থাকা নারীদের আমরা নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে কাজে নিই। এতে তাদের বাড়তি আয় হয়।

আবেদ মোড় এলাকার আরতি রানী বলেন, সংসারের বাড়তি আয়ের আশায় লিচু মৌসুমে সারাদিন কাজ করি। যে আয় তা দিয়ে কেউ ছাগল, কেউ ঘরের আসবাবপত্রসহ সাংসারিক কাজে ব্যবহৃত হাঁড়ি-পাতিল কিনি। এ টাকা ছেলেমেয়ের পড়াশোনার কাজেও অনেকে ব্যয় করে। লিচু বাগানে কাজ করলে বাড়তি টাকা আয় করা যায়।

আওতাপাড়ার লিচুকন্যা রোজিনা খাতুন বলেন, বাড়তি আয়ের আশায় সংসারের কাজের ফাঁকে বাগানে কাজ করি। সারাদিন কাজ শেষে ৪০০ টাকা হাজিরা পাই। অথচ একই কাজে পুরুষরা পায় ৬০০-৭০০ টাকা। আমরা নারীরা বৈষম্যের শিকার।

চরমিরকামারীর স্কুল ছাত্রী আশা খাতুন বলেন, লিচু মৌসুমে কাজ করে আমার মতো শত শত স্কুল-কলেজের ছাত্রী। মজুরি হিসেবে যে টাকা পাই তা দিয়ে সারা বছরের পড়াশোনার খরচ হয়ে যায়। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি বাগানে কাজ করি।

 বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী নারীদের পারিশ্রমিক কম জানিয়ে শেফালী দাস বলেন, আমরা মেয়ে বলে আমাদের মজুরি কম। মজুরি বাড়ানোর দাবি জানালেও বাগানমালিকরা এর চেয়ে বেশি মজুরি দিতে চান না। এ বছর লিচুর ফলন ও কম তাই কম পারিশ্রমিকেই কাজ করতে হচ্ছে।

জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত লিচুচাষি আব্দুল জলিল কিতাব জানান, লিচু বাছাই ও গণনার কাজে নারী শ্রমিকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এখন শ্রমিকের যে সংকট, তাতে নারী শ্রমিক না থাকলে লিচু বাছাই ও গণনার কাজ কঠিন হয়ে যেতো। এবারে নারীদের ৪০০ টাকা মজুরি এবং সকাল-দুপুরে খাবার দিতে হয়। গত বছর মজুরি ছিল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এবারে কোথায়ও কোথায়ও বাড়িয়ে ৪০০ করা হয়েছে। তবে নারী-পুরুষ সমান মজুরি হওয়া সময়ের দাবী। পুরুষের তুলনায় নারীরা কোন দিক পিছিয়ে নেই।

ঈশ্বরদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজনীন আক্তার বলেন, নারী-পুরুষ সমান অধিকার থাকলেও কিছু প্রতিবন্ধকতার দিক থেকে বৈষম্যর সৃষ্টি করা হয়। ফলে নারীরা অবহেলীত হয়। একই কর্মঘন্টায় পুরুষের চেয়ে অর্ধেক মজুরি নিতে হচ্ছে নারীদের। নারীরা যতটুকু কাজ করবে ততটুকুই মজুরি পাবে। যদি এটা বাস্তবায়ন না হয় তবে আমি মনে করি নারীদের প্রতি অন্যায় ও অবহেলার পরিমান দিন দিন বেড়েই যাবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা নারীদের অধিকার আদায়ে কাজ করছি। নারীরা পুরুষের তুলনায় কাজও বেশি করেন, অথচ মজুরি কম পাচ্ছেন। তাদের মজুরি বৈষম্য নিয়ে কথা বলছি। এর সমাধান হওয়া জরুরি।


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ