নয়া দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে বাস টার্মিনালের চাঁদাবাজি
- মোমেন্টস ডেস্ক
- প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৪ AM , আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৪ AM
সরকার পতনের পর সবার আগে দখল হয়েছে দক্ষিণের সব বাস টার্মিনাল। টাকা বানানোর মেশিনখ্যাত এই টার্মিনালগুলো দখলে নিতে যেন মুখিয়ে ছিল সুযোগসন্ধানীরা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টার্মিনালগুলো দখল হয়ে যায়। এখন চলছে দখলের বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা। নিয়ন্ত্রণ বদল হলেও টার্মিনালগুলোতে চাঁদাবাজি আর লুটপাট আগের মতোই চলছে। সাধারণ বাস মালিকদের বঞ্চিত করে অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে টার্মিনালগুলোতে। নয়া দখলদাররা মানছেন না সেসব অভিযোগ।
ক্ষমতার পালাবদল শুধু নয়, নেতৃত্বের উত্থান-পতনেও পালটায় টার্মিনালের মালিকানা। একটা সময়ে বরিশালের দুই বাস টার্মিনাল ছিল সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে তার চাচা খোকন সেরনিয়াবাত মেয়র হলে বদলে যায় সেই মালিকানা। ক্ষমতা আর নেতৃত্বের উত্থান-পতনে এভাবে মালিকানা বদলের নেপথ্যে থাকে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য। পরিচয় না প্রকাশের শর্তে একাধিক বাস মালিক বলেন, ‘সবচেয়ে ছোট টার্মিনালেও দৈনিক আয় হয় লাখের বেশি টাকা। প্রতিবার একটি বাস টার্মিনাল ছেড়ে যাওয়া, কাউন্টার চার্জ, দূরপাল্লার পরিবহণ চাঁদা, নতুন পরিবহণের অনুমতি এবং পার্কিংসহ নানা খাত থেকে আসে এই আয়। এর নির্দিষ্ট একটা অঙ্ক পান শীর্ষ নেতারা। কখনো কখনো পুরোটাই নেন তারা। যে কারণে টার্মিনালের দখল পেতে মরিয়া থাকে অনেকে। দখল মানেই টাকার কুমির হওয়ার সুযোগ।’
৫ আগস্টের পর বরিশালের রূপাতলী বাস টার্মিনালের আহ্বায়ক হন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। একাধিক বাস মালিক বলেন, ‘সরকার পতনের দিনই লোকজন নিয়ে টার্মিনাল দখলে নেন জিয়া। পরে ৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করে নিজে হন আহ্বায়ক। দখল পাকাপোক্ত করতে সেই কমিটিতে রাখেন আওয়ামী ঘরানার ৪ জনকে। একজন আছেন তার আত্মীয়। বর্তমানে টার্মিনালের সব আয় রাখছেন নিজের কাছে। সমিতির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে নামমাত্র অর্থ। আগের মতো চাঁদাবাজিও রয়েছে অব্যাহত। এরই মধ্যে টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ওয়ার্ড বিএনপির এক নেতার সঙ্গে হয়েছে বিরোধ। এ নিয়ে সেখানে হামলা-সংঘর্ষও হয়েছে।’
অভিযোগ অস্বীকার করে জিয়া বলেন, ‘৫ আগস্টের পর পালিয়ে যান মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক নেতারা। বন্ধ হয়ে যায় বাস চলাচল। সমস্যা সমাধানে সমিতির সদস্যরাই জোর করে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তলবি সভায় ৯০ মালিকের মধ্যে ৮৫ জনের সমর্থনে হয়েছে কমিটি। যেহেতু ব্যবসায়ী সংগঠন তাই সব মতের মালিক থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। ৩৬ বছর পরিবহণ ব্যবসা করি। সাধারণ সম্পাদকও ছিলাম। চাঁদাবাজি-অর্থ লোপাটের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব।’
বরিশালের আরেক বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদের হর্তাকর্তা এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক এমপি মজিবর রহমান সরোয়ারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন। ৫ আগস্ট থেকে নিয়মিত টার্মিনালে যাচ্ছেন তিনি। কয়েকজন বাস মালিকের ভাষ্য, তার কথাতেই চলছে এখন ঐতিহ্যবাহী এই টার্মিনাল। যদিও কাগজে-কলমে তিনি নেননি দখল। এই টার্মিনালেও দৈনিক আয় লাখ টাকার ওপরে। যার নিয়ন্ত্রণ মোশাররফের হাতে। এক সময় মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। বছরপাঁচেক আগে বাস বিক্রি করে সরে যান পরিবহণ ব্যবসা থেকে। ৫ আগস্টের পর আবার কিনেছেন বাস। একাধিক বাস মালিক বলেন, ‘বিএনপি নেতা সরোয়ারের ভাই ছাড়া আর কোনো দলীয় পরিচয় নেই তার। অথচ তিনিই চালাচ্ছেন বাস টার্মিনাল। তাকে না জানিয়ে কেউ করতে পারছে না কিছু। কেবল মোশাররফই নয়, সরোয়ারের আরেক ভাই ওয়াহিদুল ইসলামও আছেন টার্মিনালে। শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি।’
যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন মোশাররফ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবারও পরিবহণ ব্যবসায় নেমেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১৩ আগস্ট আবার বাস কিনেছি। সমিতি চালাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক। পূর্ণ পদে যারা ছিলেন তারা পালিয়ে গেছেন। সাধারণ সদস্য হিসাবে আমি টার্মিনালে যাই। প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নই আসে না। আমার বিষয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’
বরিশালের মতো দখল হয়েছে পটুয়াখালী-ভোলা-বরগুনা আর ঝালকাঠির বাস টার্মিনাল। ৬ আগস্ট বদলে যায় বরগুনা জেলা বাস মালিক সমিতির মালিকানা। হঠাৎ কমিটির আহ্বায়ক হন বিএনপি নেতা হারুন অর রশিদ। যুগ্ম আহ্বায়ক পদে আসেন জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারুক সিকদার। নিত্যদিন লাখ টাকা আয়ের টার্মিনালে কী করে হঠাৎ নেতা হলেন জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘১৮ মাস আগে মালিক সমিতির মেয়াদ শেষ হয়। তাছাড়া ৫ আগস্ট বরগুনা ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক নেতারা। পরে সবাই তলবি সভা করে আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। ৭০ সদস্যের অধিকাংশ সভায় উপস্থিত ছিলেন।’ পটুয়াখালীতে বাস মালিক সমিতির নয়া সভাপতি ও সম্পাদক হয়েছেন দুই বিএনপি নেতা বশির মৃধা ও খন্দকার ইমাম হোসেন। ৫ আগস্টের পর হয়েছে এই বদল। তলবি সভার মাধ্যমে সভাপতি হওয়ার দাবি করে বশির মৃধা বলেন, ‘১০০ সদস্যের ৮৫ জন সভায় উপস্থিত ছিলেন। আগের কমিটির নেতারা পালিয়ে যাওয়ার পর এই কমিটি হয়েছে।’
সাবেক কমিটির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন মৃধা বলেন, ‘অনুমোদিত বৈধ কমিটির সভাপতি ছিলাম। আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। সর্বশেষ আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এরপর তারা জোর করে দখলে নেয় মালিক সমিতি।’
ঝালকাঠি জেলায় ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। সাবেক নেতারা পালিয়ে যাওয়ার পর প্রকৃত বাস মালিকরাই করেছেন নয়া কমিটি। যদিও সেই কমিটির আহ্বায়ক বাচ্চু হাওলাদার ও সদস্য সচিব আব্দুল মান্নান বিএনপি ঘরানারই। ১১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির উপদেষ্টা হয়েছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাৎ হোসেন। যদিও কোনো বাস নেই তার। বাস মালিকদের কয়েকজন বলেন, ‘নিজ ইচ্ছাতেই উপদেষ্টা হয়েছেন শাহাদাৎ। বিনিময়ে রয়েছে নগদ অঙ্কের হিসাব-নিকাশ। তিনিই এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন সমিতি।’ শাহাদাৎ বলেন, ‘আমাকে উপদেষ্টা করার খবর পরে পেয়েছি। তাদের বলেছি নাম বাদ দিতে। পরবর্তী সভায় আমার নাম বাদ দেবে জানিয়েছে।’
বিভিন্ন বাস মালিক সমিতির সদস্যরা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর যখন অস্থিতিশীল পরিবেশ, ঠিক তখন টার্মিনালগুলো দখলে নিয়েছেন বিএনপি নেতারা। আমাদের বাধ্য করেছে তাদের কথামতো বিভিন্ন কাগজ আর রেজুলেশনে সই দিতে। বিএনপি ক্ষমতায় আসছে ভেবে আমরাও কোনো প্রতিবাদ করিনি। এখন দেখছি সবই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আওয়ামী লীগ যা করে গেছে ঠিক তাই-ই করছে বিএনপি। চাঁদাবাজি লুটপাটের কোনো পরিবর্তন হয়নি।’