ভিপি নুরের দলে ভাঙ্গন, কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ!
- মোমেন্টস ডেস্ক
- প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৩, ০৪:৪৮ PM , আপডেট: ২০ জুন ২০২৩, ০৪:৪৮ PM

কয়েকদিন ধরেই গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের মধ্যে কোন্দলের খবর সমানে আসছে। এর মধ্যে তারই দলের নেতাকর্মীরা অভিযোগ তুলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্টের সঙ্গে বৈঠক শেষে একটি কালো রংয়ের ব্যাগে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, দলের নামে তহবিল এনে কাতারেই এক প্রবাসীর গাড়ি ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়েছে, নুরের বিরুদ্ধে দেশের একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া, বিভিন্ন ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ, দলের জন্য প্রবাসীদের দেওয়া টাকার হিসাব না দেওয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগ এনেছেন দলের কয়েকজন নেতা। এসব কারণেই রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে।
সোমবার (১৯ জুন) রাতে নুরুল হক নূর তার ফেসবুক আইডিতে স্ট্যাটাসে দলটির আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন। এর জেরে এবার নূরের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করলেন রেজা কিবরিয়া। সোমবার রাতে রেজা কিবরিয়া সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেন।
ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, দলের মধ্যে টাকা-পয়সার হিসাব চাওয়া নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। নুর প্রবাসে কমিটি গঠনের ব্যাপারে নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে অনুমোদন দিয়েছেন। অথচ দলের প্রধান হিসেবে আমাকে ওই পদ দেওয়ার কথা। দলীয় ফান্ডের কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই। কাউকে হিসাবনিকাশ দিতে চান না তিনি। আমি দলের প্রধান, কিন্তু আমাকে হিসাবনিকাশ দেন না। এখন আমি হিসাব চাওয়াতে তিনি আজেবাজে কথা বলছেন। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে তিনি যে বৈঠক করেছেন; এটি কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই।
তিনি বলেন, কী কারণে, কেন ওই বৈঠক করলেন এবং বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন কেন? ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? তারা কি দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাবে? নাকি ভিপি নুর টাকা পেয়েছেন? অবশ্য যারা তাকে গাড়িতে করে নিয়ে গেছেন তারা জানিয়েছেন, বৈঠকের পর ‘কালো একটি ব্যাগ’ নিয়ে তিনি গাড়িতে উঠেছেন। টাকা-পয়সা নিয়ে তিনি কী করেছেন? নিজের স্বাক্ষরে কেন করেছেন– জানি না। আবার ভারতসহ বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকের সঙ্গেও গোপন বৈঠক করেন। অথচ দলের আহ্বায়ক হিসেবে আমি তা জানি না। এসব কারণে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভিপি নুর এখন বড় নেতা হয়ে গেছেন! রাজনীতি বেশি বোঝেন! আমি তার কথায় চলি না– এসব কারণে সংকটের সমাধান হবে না।
এই নেতা বলেন, অর্থ লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এসব ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলছেন। নুরের নেতৃত্বে দলের ছোট একটি অংশ এসব বলতে পারে। দলের বড় অংশ আমার সঙ্গে রয়েছে। দলের অনেক নেতাই দুঃখ প্রকাশ করে বলছেন, দলের মধ্যে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকে, তাহলে কীভাবে আমরা প্রমাণ করব– আওয়ামী লীগের চেয়ে আমাদের দল ভালো কিছু করবে?
দলের গোপন বৈঠকে যা হয়েছে:
এর আগে গত রোববার (১৮ জুন) রাতে অনুষ্ঠিত গণঅধিকার পরিষদের বৈঠকে এ নিয়ে তুলকালাম হয়ে গেছে। ঘটনার জেরে দলটির প্রধান নির্বাচন ব্যবস্থাপক এবং গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান জাকারিয়া পলাশ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। তবে গতকাল সোমবার মধ্যরাতে নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী সভায় বর্তমান কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ঘোষণা করা হয়।
দলটির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, গত রোববার সন্ধ্যায় গুলশান ২ নম্বর সেক্টরের ৫৫ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়িতে দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার বাসার ছাদে গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সংসদের বৈঠক বসে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়।
আলোচনার এক পর্যায়ে রেজা কিবরিয়া নুরুল হক নুরের ইসরায়েলি এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “গণঅধিকার পরিষদের নামে প্রবাস থেকে আসা টাকার হিসাব কোথায়? কেন নুর ইসরায়েলি মেন্দি এন সাফাদি ও তার ‘বাংলাদেশি বন্ধু’ শিপন কুমার বসুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন?” এসব নিয়ে বৈঠকের পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর আরও কয়েকজন নেতা নুরের টাকার লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এ সময় রেজা কিবরিয়া নুরের উদ্দেশে বলেন, ‘দুবাইয়ে মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে মিটিং করতে নুর ট্যাক্সি দিয়ে যাননি। তাকে আমাদের লোক (দুবাইয়ে গণঅধিকার পরিষদের নেতারা) গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছেন। তারাই কনফার্ম করেছেন যে, এ রকম মিটিং হয়েছে এবং মিটিং শেষে তিনি (নুর) একটা কালো ব্যাগ নিয়ে ফিরেছেন। তবে কালো ব্যাগে কী ছিল, সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমাদের প্রশ্ন হলো, তুমি ইসরায়েলিদের সঙ্গে মিটিং করছ, এটার কারণ কী? কারণটা আমাদের বলো?’
রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘নুর এত গাড়ি কোথায় পায়! এর আগে বলা হয়েছিল কাতারের সভাপতি গাড়ি দিয়েছে। এভাবে চলতে পারে না। কাতারের সভাপতি কেন গাড়ি দেবে? তাহলে কি সংগঠন অন্যদের মতোই হবে। এরপর যে নেতা হবে, সে-ও এ রকম গাড়ি পাবে। গাড়ি দিলে, তাকে কেন সভাপতি বানাতে হবে। সভাপতি বানানোর বিনিময়ে গাড়ি কেন নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুসারে বিদেশের কমিটি দুজনের দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা না করে সব কমিটি একাই করছ। লাখ লাখ টাকা আসে, সেই টাকা তুমি কী করো? এক টাকাও তো দলে দাও না।’
রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘তুমি এর আগে দেশের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ীকে ফুল দিয়ে এসেছে। তার থেকে কয় টাকা খেয়েছ?’
তখন নুর বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ আমাকে গাড়ি দিতে পারে। আমি পার্টির প্রেসিডেন্ট না। কিন্তু আমি ডাকসুর সাবেক ভিপি। আমার পরিচিত আছে।’
এ সময় আর একজন যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, ‘কাতারে গাড়ির ব্যবসা রয়েছে নুরের। এ ছাড়াও দেশে বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ও টাকা খাটাচ্ছেন। বিদেশ থেকে আসা টাকার কোনো হিসাব দিতে চান না। দল তো কারও একার নয়, স্বচ্ছতা না রেখে এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে লেনদেন হতে পারে না।’
এসব বিষয়ে নুর তার বক্তব্যে সাফাদির কাছ থেকে টাকা আনার বিষয়টি অস্বীকার না করে বলেন, ‘বিভিন্ন স্থান থেকে টাকা আনি দলের জন্য। তা দলের পেছনেই ব্যয় করি। কাতারে আমার কোনো ব্যবসা নেই। সেখানে পরিচিত একজন ব্যবসায়ীর গাড়ির শোরুম রয়েছে। তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম এ পর্যন্তই।’
এক পর্যায়ে আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া দলের অর্থ বিভাগের প্রধান শহিদুল হক ফাহিমের কাছে আর্থিক হিসাব-নিকাশের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সরকার যদি কখনো কোনো সংস্থা দিয়ে আর্থিক বিষয়গুলো অডিট করায়, তখন মামলা খেতে হবে। তুমি দলকেও বিপদে ফেলবে।’
বৈঠকের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. শামসুদ্দীন আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘আমাদের দলের দুই শীর্ষ নেতার একজন কি তাহলে সিআইএর, একজন মোসাদের। আমরা দল তাহলে কার জন্য করছি! বাংলাদেশের রাজনীতি না করে আমরা কি সিআইএ এবং মোসাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছি।’
রেজা কিবরিয়া চলে যাওয়ার পরে তার প্রতি অনাস্থা এনে রাশেদ খানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ঘোষণা করা হয়। তখন দলের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও বৈঠকের সঞ্চালক জাকারিয়া পলাশ বলেন, ‘অনাস্থা প্রস্তাব আনতে গঠনতন্ত্র অনুসারে দুই-তৃতীয়াংশ কাউন্সিলরের সমর্থন লাগবে। আপনারা সেটা না করে এভাবে করতে পারেন না।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে সদস্য সচিব নুর ওই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন।