আয় বাড়ানোর পথ খুঁজছে সরকার

অর্থনীতি
  © ফাইল ছবি

দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নানামুখী কর্মযজ্ঞে বাড়ছে অর্থনীতির আকার। নানা সূচকেও অর্থনীতির বাঁকবদলের এই ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না সরকারের রাজস্ব আয়। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় সর্বনিম্ন বাংলাদেশের কর জিডিপির হার। অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখান থেকে উত্তরণের সম্ভাবনাও খুব বেশি নেই। আয় বাড়ানোর নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ে বড় রকম ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত অনুযায়ী, রাজস্ব আয় জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। বাস্তবে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ২০ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। তবে সংশোধিত এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাও চ্যালেঞ্জিং বলে এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করেন।

এনবিআরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের মূল বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা ২০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক মিলে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। এই সময়ে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রথম ছয় মাসেই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী সৌদি আরব

শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে এনবিআরকে অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে আরও ২ লাখ ১৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলেও আদায় করতে হবে ১ লাখ ৯৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব আহরণের গতি কমার কারণে প্রতিমা সে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে। এই গতিতে রাজস্ব আদায় হলে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছিল। এবার ঘাটতি আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে হলে চলতি অর্থবছরে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অর্থনীতির গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের আইএমএফ যে শর্ত দিয়েছে, তা পূরণ হওয়া প্রায় অসম্ভব। রাজস্ব আহরণে যেসব সংস্কার প্রয়োজন, তা হচ্ছে না। আইএমএফের কাছে যেসব খাতে অব্যাহতি কমিয়ে আনার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, তাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যার কারণে রাজস্ব আহরণে গতি আসছে না। এ ছাড়া কর প্রশাসনের সংস্কার এবং কর প্রদান প্রক্রিয়ায় জটিলতা দূর করা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাট আদায় করে অনেকে সরকারি কোষাগারে ঠিকমতো জমা দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে রাজস্ব আহরণ প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। আর চলতি অর্থবছরের বাজেটে যেসব বিষয় উল্লেখ করে রাজস্ব আয় বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে না।’

এদিকে চলতি অর্থবছরে আয়কর খাতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য জমির রেজিস্ট্রেশনের কর হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পানীয়সহ কিছু ক্ষেত্রে উৎসে কর থেকে বাড়তি রাজস্ব আহরণে কথা আইএমএফকে জানায় এনবিআর। বাজেট পাসের পর জমির রেজিস্ট্রেশনের নির্ধারিত হার কমিয়ে দেওয়া হয়। আরও কিছু সংস্কারের বিষয় থাকলেও বাস্তবে কার্যকর হয়নি। এ কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আয়কর খাতে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। একই পরিস্থিতি ভ্যাট আদায়েও। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭০ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। বিপরীতে আদায় হয়েছে ৬৪ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। আর মূল্যস্ফীতি বাড়লে পণ্যের দাম বাড়ে। আর ভ্যাট নির্ধারণ হয় মূল্যের ওপর। সেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এবার ভ্যাট আদায় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ খাতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। ভ্যাট ফাঁকি থেকে শুরু করে নানা জটিলতার কারণে এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন খোদ ভ্যাট কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন: শুল্কহার কমানোর ঘোষণার ১দিন পরেই কমেছে ভোগ্যপণ্যের দাম

রাজস্ব আহরণের বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সম্প্রতি বলেছেন, ‘আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব বাড়ানোকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।’ এর আগে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি মন্তব্য করেন, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন খুবই চ্যালেঞ্জিং।’

এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৭ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। শুল্ক বিভাগ আদায় করেছে ৪৯ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে শুল্ক আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। শুল্ক কর্মকর্তারা বলছেন, এলসি কমে যাওয়ার কারণে শুল্ক আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে শুল্কের বকেয়া আদায়, শুল্ক হার বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক পণ্যমূল্য বাড়ার কারণে শুল্ক আদায় বাড়লেও প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। এ ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণার কারণেও সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। এ ছাড়া শুল্ক কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে এলসি জটিলতা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এলসির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থায় গত অর্থবছরের পর এবারও আমদানি কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য এলসি নিষ্পত্তি ১৮ শতাংশের বেশি কমে ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারে নেমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি। ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্পের কাঁচামালের এলসি ৩১ শতাংশের বেশি কমে ১ হাজার ৫৪ কোটি ডলারে নেমেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি প্রায় ২৭ শতাংশ কমে ১৪৩ কোটি ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছর আমদানি ১৬ শতাংশের মতো কমে ৬ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারে নেমেছিল। এর মধ্যে মূলধনি পণ্যের আমদানি ২৪ শতাংশের বেশি এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি প্রায় ২২ শতাংশ কমেছিল।


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ