জিআই নিতে হঠাৎ তাড়াহুড়া কেন?

জিআই
  © ফাইল ছবি

ভারত টাঙ্গাইল শাড়ির জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতির সনদ নেওয়ার পর টনক নড়েছে সরকারের দায়িত্বশীলদের। এর এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। এর পাঁচদিন বাদে আরও কয়েকটি পণ্যকে জিআই হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই ভারতের হাতে চলে যাওয়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের পণ্য হলেও সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় পণ্যটির জিআই নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে। ডিপিডিটি জিআই স্বীকৃতিতে বিলম্ব করেছে। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব দেশের অভিন্ন পণ্যগুলো জিআই সনদভুক্ত করার তাগিদ অর্থনীতিবিদ ও জিআই বিশেষজ্ঞদের।

জানা যায়, ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল ২০২০ সালে। এরপর চার বছর এ নিয়ে কাজ হয়েছে। এসব তথ্য ওয়েবসাইটেই ছিল। কিন্তু এতদিন ধরে ডিপিডিটি কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় কোনো তাগাদা দেয়নি। এমনকি বাংলাদেশে এ পণ্যের জিআইয়ের জন্য টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও শাড়ির জিআইয়ের আবেদন করা হয়নি। শুধু সরকার নয়, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরও কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ভারত ঘোষণা দেওয়ার পর যেন সবার ঘুম ভেঙেছে।

আরও পড়ুন: ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে ফাঁদ; সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা

অনেকে বলছেন, এতদিন চুপ থেকে তাড়াহুড়া করে জিআই নিতে গিয়ে ভুল করলে আমরা সমস্যায় পড়তে পারি। জিআই হাতছাড়া হওয়ারও আশঙ্কা থাকবে। কারণ, জিআইয়ের জন্য বেশ কিছু নিয়ে নিয়ম মানতে হয়, তথ্য-উপাত্ত দিতে হয়। এগুলো যদি আমরা ঠিকঠাক না দিতে পারি তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই সাবধানে এগোতে হবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য মন্তব্য করেছেন, ‘এখন জিআই নিয়ে এত তোড়জোড়। এতদিন ধরে আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কী করলো? শুধু সরকার নয়, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরও কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এটা আমাদের অজ্ঞতা ও ব্যর্থতা। কিন্তু এখন যেভাবে তাড়াহুড়া করে এর জিআই করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তা অমূলক। এত তাড়াহুড়ায় আমরা আবার ভুল করে বসতে পারি।’

জিআই কী এবং কেন দরকার
কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়।

সাধারণত জিআইতে উৎপত্তিস্থলের নাম (শহর, অঞ্চল বা দেশ) অন্তর্ভুক্ত থাকে। জিআই (GI) এর পূর্ণরূপ হলো (Geographical indication) ভৌগলিক নির্দেশক। WIPO (world intellectual property organization) হলো জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দানকারী প্রতিষ্ঠান। কোনো দেশ জিআই নিবন্ধনের জন্য অবেদনের পরে ওই প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই করে পণ্যের চূড়ান্ত জিআই দেয়।

কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। যাচাই-বাছাইয়ের পর এগুলোর কোনোটি যদি জিআই সনদ পেয়ে যায়, তাহলে তখন সেগুলো ওই দেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে যে পণ্যের জিআই হবে, সে পণ্যের জন্য সুবিধাভোগী হবে শুধু বাংলাদেশ।

২০১২ সালের দিকে জামদানি শাড়ি, আম ও ইলিশকে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ভারত। অথচ এসব পণ্য বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু পণ্য জিআই করার জন্য দেশে তখন কোনো আইন ছিল না। বেশ দ্রুততার সঙ্গে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। এর দুই বছর পর ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়। ডিপিডিটি এ সংক্রান্ত সরকারি নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান। একদম শুরুতেই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য চিহ্নিত করে ওই জেলার প্রশাসক আবেদন করেন ডিপিডিটিতে। সেই আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে সনদ দেওয়ার আইনি ক্ষমতা ডিপিডিটিকে দেওয়া হয়েছে।

কোনো দেশ নির্ধারিত কোনো পণ্যের চূড়ান্ত জিআইয়ের জন্য WIPO-তে আবেদন করে। তবে আবেদনের অর্থ এই নয় যে সেগুলোর জিআই সনদ ওই দেশই পাবে। অথবা ওই পণ্যই পাবে। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্ধারিত হয় যে কোন পণ্য বিশ্বব্যাপী জিআই-এর তালিকায় উঠবে।

বাংলাদেশের জিআই পণ্য ৩১টি
বাংলাদেশে অনুমোদিত জিআই পণ্যের সংখ্যা এখন ৩১টি। ২০১৬ সালে জামদানি শাড়িকে বাংলাদেশে প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর স্বীকৃতি পায় আরও ২০টি পণ্য। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারীভোগ, বাংলাদেশ কালিজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, বাংলাদেশের শীতল পাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসিমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, টাঙ্গাইল শাড়ি, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম, মৌলভীবাজরের আগর, মৌলভীবাজারের আগর আতর, মুক্তগাছার মন্ডা, যশোরের খেজুরের গুড়, রাজশাহীর মিষ্টি পান এবং জামালপুরের নকশিকাঁথা।

এখন জিআই নিয়ে সতর্ক সরকার
গত রোববার মন্ত্রিসভার বৈঠকে টাঙ্গাইল শাড়িসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পেটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক এবং আটটি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারকে প্রতিটি জেলায় জিআই পণ্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে ওই বৈঠকে।

এদিকে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ভারত জিআই সনদ নিলেও টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের ছিল, আমাদের আছে, আমাদের থাকবে। এজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়াসহ যা যা করা দরকার, তা করা হবে।


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ