সিটির উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ যখন নগরবাসীর গলার কাঁটা!
- ওসমান গনি
- প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৪, ০১:১১ PM , আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৪, ০১:১৩ PM
একদিকে ঠিকাদারের রাজনৈতিক প্রভাব, প্রতিপত্তি ও স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যদিকে জবাবদিহি না থাকায় রাজধানীজুড়ে সিটি করপোরেশনের চলমান উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ নগরবাসীর গলার কাঁটায় পরিণত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঠিকাদার টেন্ডার বাগিয়ে এনে বেমালুম ভুলে যান কাজের ডেডলাইন। সংস্কারের নামে মাসের পর মাস খুঁড়ে রাখা রাস্তা তৈরি করছে জনভোগান্তি। আধুনিক যুগে এমন বিড়ম্বনা মেনে নেয়া যায় না; একথা উল্লেখ করে উন্নয়নযজ্ঞে আধুনিক পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
প্রায় দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল ১ হাজার ৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার রাজধানী ঢাকা। প্রয়োজনের তুলনায় এই শহরে সড়ক অপ্রতুল, আবার যেটুকু আছে, তার কতটুকু ব্যবহারযোগ্য তা নিয়েও আছে প্রশ্ন।
প্রধান সড়ক নয়, দৃষ্টি দেয়া যাক অলিগলির দিকে। সড়ক শুধু চলার পথই নয়, পয়ঃনিষ্কাশন, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নানা সেবা সংস্থার লাইন চলে যায় এর নিচ দিয়ে। এটিই শহুরে বাস্তবতা। কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না, চিরচেনা সেই বাস্তবতা বর্তমানে রূপ নিয়েছে তিক্ততায়।
রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকায় ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের সড়কটি খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে প্রায় এক বছর ধরে। সড়কের নিচে ড্রেনেজ ব্যবস্থার জন্য নতুন পাইপ লাইন বসানো হলেও কেটে রাখা রাস্তা এখনো হয়নি ঠিকঠাক। কোথাও কোথাও উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ম্যানহোল। প্রতিদিন রুগ্ন এই সড়ক ধরেই হাজারো মানুষের যাতায়াত। ভয়াবহ ঝুঁকি মাথায় নিয়েই ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের স্কুলযাত্রা। যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও খোঁজ নেই ঠিকাদারের। যেন রাস্তা খুঁড়েই দায় শেষ।
স্থানীয়রা বলছেন, নির্বাচনের আগেই রাস্তাটা ঠিক করে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেয়া হয়নি। এখন এ পথ দিয়ে যাতায়াতে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় তো এদিক দিয়ে চলাচলই করা যাবে না। বৃষ্টির পানিতে ঢেকে থাকলে গর্তে পড়ে গেলেই মৃত্যু নিশ্চিত!
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তথ্য বলছে, সড়কটির ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার কাজ পায় সাবেক থানা যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স মা কনস্ট্রাকশন। ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭৫০ মিটার দৈর্ঘের সড়কটির কাজ শুরু হয় গত বছরের এপ্রিলে। একই বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা ঝুলে আছে এলাকাবাসীর গলার কাঁটা হয়ে।
এটা তো গেল একটি এলাকার একটি সড়কের আত্মকাহিনী। ব্যতিক্রম নয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্যান্য পাড়া-মহল্লার শাখা পথগুলোও। কোথাও সড়ক রূপ নিয়েছে পাহাড়ি টিলায়। যানবানহ চলাচলতো দূরের কথা পায়ে হাঁটাও দুঃসাধ্য। আবার কোথাও সড়কের কাজ শুরুর আগেই ফেলে রাখা হয়েছে বড় বড় পাইপ। এ যেন সেবা নয়, বরং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব।
এলাকাবাসী বলছেন, একদিন কাজ চললে আবার বহুদিন কাজের কোনো খবর থাকে না। উপকার যতটুকু হবে, তার চেয়ে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে। ভাঙতে সময় লাগে না, কিন্তু গড়তে সময় লাগে।
এদিকে সড়কের এমন করুণ পরিণতির জন্য সিটি করপোরেশনের দীর্ঘদিনের জবাবদিহিতার সংস্কৃতির অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক পরিচয় নয়, বরং কাজের মান, স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের মানদণ্ডকে প্রাধান্য দিলে সম্ভব সংকট মুক্তি।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, স্বচ্ছতা ও কন্ট্রাকটরের সার্টিফিকেশন বিষয়গুলোতে আমাদের কোনো উন্নয়ন হয়নি। কন্ট্রাকটর নিয়োগ হচ্ছে পুরোপুরি রাজনৈতিক বিবেচনায়। ‘এটা আমার কাছে অরাজকতার সংস্কৃতি মনে হয়। আমাদের টাকার অংক বাড়ছে। কিন্তু গুণগত মান খারাপ হচ্ছে। আমি ১০ কিলোমিটার রাস্তা একদিনে করতে পারবো না। তাহলে ১০ কিলোমিটার খুঁড়ে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলার তো দরকার নেই। যতটুকু খোঁড়া হবে, পরদিন মানুষ দেখবে যে রাস্তা সম্পন্ন হয়ে গেছে। বিষয়টা এমন হওয়া উচিত,’।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়টা কোনো মুখ্য বিষয় নয়। কাকে দিয়ে কাজটি করালে সহায়ক হবে, কাজটি মানসম্মতভাবে করা যাবে, সেটিই সরকারি বিধিবিধান সাপেক্ষে করা হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সব সময় সচেতন থাকি। ন্যূনতম ভোগান্তি দিয়ে আমরা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনা করি। যদিও কেউ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তবে তাকে জরিমানা করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে তার কাজও বন্ধ করে দেয়া হয়।’
উল্লেখ্য, চলমান কাজ দ্রুত শেষ করা না গেলে আসছে বর্ষায় মৃত্যুফাঁদে রূপ নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে উন্নয়নমূলক এসব কর্মকাণ্ড।