নারী নিপীড়নের অভিযুক্তকে বসানো হয়েছে থিয়েটারের সম্পাদক পদে

জাবি
  © সংগৃহীত

নারী নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত চন্দন সমাদ্দার সোম ওরফে হিমাদ্রীকে জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার (অডিটোরিয়াম)- এর সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। নিপীড়নের বিষয়টি সংগঠনটি অবগত থাকলেও সেটি উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে তৎকালীন নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে।

অভিযুক্ত দ্বারা কয়েক দফায় মারধরের শিকার হয়ে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বিশ^বিদ্যালয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। পরে ওই শিক্ষার্থী সাংস্কৃতিক জোটের তৎকালীন সভাপতি সৌমিক বাগচীর কাছেও মৌখিক অভিযোগ করেন। 
ঘটনাটি ২০২২ সালের। তখন হিমাদ্রী জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। সেসময় ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী থিয়েটারের নেতৃবৃন্দ, ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তকে নিয়ে বসে। 

এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি সৌমিক বাগচী বলেন, ওই শিক্ষার্থী আমাকে মৌখিকভাবে বিষয়টি জানায়। পরে দুই পক্ষকে নিয়ে বসি। উভয়পক্ষই মারামারির ঘটনাটি স্বীকার করেন। ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা হয়। 

এই বিচারের একমাস পর হিমাদ্রী সম্পাদকের দায়িত্ব পান।  নারী নিপীড়নে অভিযুক্তকে সম্পাদকের পদ কেন দেওয়া হল এ বিষয়ে জানতে তৎকালীন সম্পাদক হুমায়ন ইবনে জামান বলেন, ঘটনাটি সম্পর্কে আমরা জানতাম । কিন্তু বিষয়টি তাদের ব্যক্তিগত ছিলো। আমাদের কাছে কোন লিখিত অভিযোগ কেউ দেয়নি।

কিন্তু পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার এক মাসের মধ্যে বটতলায় ওই নারীর গায়ে আবারো হাত তুলেন হিমাদ্রী। হিমাদ্রীর সাবেক দুই প্রেমিকার তথ্য মতে, ‘হিমাদ্রী কথায় কথায় তাদের গায়ে হাত তুলতো। এজন্য তারা সম্পর্ক থেকে সরে এসেছে।

পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে সাংস্কৃতিক জোটের ভূমিকা কী হবে এ নিয়ে মিটিং হয়। এ সময় একজন বলে উঠে আমাদের মধ্যে একজন নিপীড়ক লুকিয়ে আছে।  তাকে নিয়ে আমরা আন্দোলনে যাব না।’ তখন ঘটনাটি জানাজানি হয়। 

এ বিষয়ে ওই মিটিংয়ে উপস্থিত এক নেতা জানান, নিপীড়নের বিষয়টি সামনে আসার পরে আমরা থিয়েটারের কাছে বিষয়টি জানতে চাই তখন তারা বিষয়টি ব্যক্তিগত বলে উড়িয়ে দেয়।

পরে ভুক্তভোগী ওই নারীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ঘটনাটি ২০২২ সালের। তখন তার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো।  তার দ্বারা চারবার গুরুতরভাবে আহত হই । হিমাদ্রী আমার কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছে, আঙুল ভেঙ্গে দিয়েছে, মাটিতে ফেলে বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরেছিলো। এ নিয়ে অভিযোগ করেও আমি কোন প্রতিকার পাইনি । এবং হিমাদ্রী এখনও  আমাকে নানানভাবে  হেয় করে । আমার পরিচিতদের মধ্যে কুৎসা ছড়িয়ে বেড়ায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম ঘটনা বিশ^বিদ্যালয়ের শহীদ মিনার এলাকায়। এসময় ভুক্তভোগীর কানের পর্দা ফেটে যায়। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঘটনাটি ২২ সালের ৬ জুনের। যেখানে দেখা যাচেছ ভুক্তভোগী কানে গুরুতর আঘাত পেয়েছে। 

ভুক্তভোগী বলেন, ওই সময় আমাদের মাঝে মনোমালিন্য চলছিলো। আমার ফোনটি হিমাদ্রীর কাছে ছিলো । সে ফোনটি দিতে শহীদ মিনারে আসে। তখন সে পিছন থেকে আমাকে ডাক দেয়। আমি শুনতে না পাওয়ায় আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয় । আমি এর প্রতিবাদ করতে গেলে আমার কানে পরপর তিনটি থাপ্পড় মারে । এতে আমার কানের পর্দা ফেটে যায়।

এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফার্মেসি বিভাগের ৪৬ তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, ওই দিন আমি শহীদ মিনারে ছিলাম। তখন দেখি একটি ছেলে একটা মেয়েকে মারধর করছে ও টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি আমার পূর্ব পরিচিত ছিলো। কিন্তু ছেলেটিকে আমি চিনতাম না।

দ্বিতীয় ঘটনা টারজান পয়েন্ট এলাকায়। এখানে ভুক্তভোগী অভিযুক্ত দ্বারা এলোপাতাড়ি মারধরে শিকার হন । ভুক্তভোগীর দাবি হিমাদ্র্রী তাকে মাটিতে ফেলে বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরেছিলো।
ওই ঘটনায় ৪৬ ব্যাচের রাসু বলেন, মারধরে ঘটনাটি সত্য। ঘটনা জানার পর আমি তাকে দেখতে মেডিকেলে যাই । সেসময় প্রক্টরের কাছে অভিযুক্তের নামে অভিযোগ করা হয়। পরবর্তীতে  অভিযোগ তুলে নেওয়া হয় বলে শুনেছিলাম। এছাড়াও ৪৬ ও ৪৭ ব্যাচের আরো দুইজন এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।  
ভুক্তভোগী মারধরের বিষয়ে বলেন, আমার সাথে সম্পর্ক চলাকালীন আমি তাকে অন্য একটি মেয়ের সাথে দেখি। বিষয়টি জানার জন্য তাকে ফোন করে ডাকলে হিমাদ্রী মাতাল অবস্থায় আমার কাছে আসে। কথা বলার একপর্যায়ে হিমাদ্রী আমাকে এলোপাতাড়ি ঘুসি থাপ্পড় মারে, বুকের উপর উঠে আমার গলা টিপে ধরে। তখন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। তখন আমি নিজেকে ছাড়াতে তার হাতে কামড় দেই । ছেড়ে দিলে আমি দৌড়ে টারজানের রাস্তায় এসে লোকজনের কাছে সাহায্য চাই।
তিনি আরো জানান, এ সময় আমি প্রক্টরের কাছে যেতে চাইলে হিমাদ্রী আমাকে হুমকি দেয় এই বলে যে, তৎকালীন প্রক্টর তার নিজের বিভাগের শিক্ষক এবং একই সাথে অজ্ঞাত কারো সাথে ভিডিও কল দিয়ে তার কাটা হাত দেখিয়ে বলতে থাকে আমি তাকে আঘাত করে রক্তাক্ত করেছি।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অর্থনীতি বিভাগের ৪৭ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, সাইকেল চালিয়ে হলপথে যাওয়ার সময় নারী কন্ঠের চিৎকার শুনে আমি এগিয়ে যাই। সেখানে জানতে পারি ভুক্তভোগীকে ছেলেটি টারজানে (উপস্থিত রাস্তার পাশের জায়গাটিতেই) শারীরিকভাবে হেনস্তা করেছে। তখন সেখানে আমার মতই আরো দুজন উপস্থিত ছিলেন। আমি মেয়েটিকে নিয়ে রিকশাতে উঠাই, ছেলেটি যেতে দিতে চাচ্ছিলো না। জোর করছিল ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পায়ে ধরছিল আবার মেয়েটির অতীত নিয়ে আজেবাজে কথা বলছিল। সেসময় ভুক্তভোগীর চোখ নিচে দাগ ও ফোলা ছিলো, শরীরে ক্ষতের চিহ্ন ছিলো।
ঘটনার পরদিন ভুক্তভোগী ও তার বন্ধুরা বিশ^বিদ্যালয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। ভুক্তভোগী জানান, ওই সময় হিমাদ্রীর ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে।  হিমাদ্রী সেসময় আমার ও আমার বন্ধুদের কাছে এসে অনুরোধ জানায় যে তার একাডেমিক জীবন নষ্ট হয়ে যাবে আমি যেন অভিযোগ তুলে ফেলি। বন্ধুদের অনুরোধে আমি সেসময় অভিযোগ তুলে ফেলি।

পরে সাংস্কৃতিক জোটের তৎকালীন সভাপতি সৌমিক বাগচীর কাছে মৌখিক অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। এ নিয়ে সৌমিক বাগচী দুইপক্ষকে নিয়ে বসেন। ভুক্তভোগীর দাবি, ‘মিটিংয়ে হিমাদ্রী বলে ‘তাকে মারার যথেষ্ট কারণ আছে, আমার কারণে থিয়েটারের সম্মান নষ্ট হলে আমি সরি, আমি আর থিয়েটার করবো না।’ মিটিং শেষে সৌমিক বাগচী আমাকে সম্পর্ক না রাখার পরামর্শ দেয় এবং এর অতিরিক্ত তিনি কিছু করতে পারবে না বলে জানায় ।’

এই ঘটনার একমাস পর হিমাদ্রী ওই থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। নিপীড়নের ঘটনাটি ওই সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানার পরেও হিমাদ্রীকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জোটভুক্ত অন্যান্য কর্মীরা।

তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে জাহাঙ্গীরনগরের বটতলা এলাকায়। ভুক্তভোগী জানান, হিমাদ্রী সম্পাদক হওয়ার পর আবারো আমার সাথে যোগাযোগ করেন। নানাভাবে অনুরোধ করে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। সম্পর্কের এক মাস পর আমার ছবিতে এক বন্ধুর কমেন্ট করাকে কেন্দ্র করে হিমাদ্রী অভিযোগ করেন আমি তার সাথে প্রতারণা করছি। এ নিয়ে বটতলায় কথা বলার জন্য বসলে বটতলায় উপস্থিত সকলের সামনে সে আমাকে চড় মারে ও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এবং বটতলার কেএফসি দোকানের পিছনে নিয়ে আমার গলা টিপে ধরে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও দোকানদাররা জানায়, ওইদিন কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে তাদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যায়। এতে ছেলেটি মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়।  

ভুক্তভোগী আরো জানায়, এই ঘটনা জানাজানি হলে এক সপ্তাহ পরে হিমাদ্রী আমার সাথে দেখা করে। তখন সে আমাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব দেয় । তাহলে সে আমাকে বিয়ে করবে। আমি মেনে না নেওয়ায় আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ হয়। 

৪৮ ব্যাচের অন্য আরেক ভুক্তভোগী জানান, হিমাদ্রীর সাথে আমারো প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। হিমাদ্রীর একটা স্বভাব ছিলো যে তার পূর্বের প্রেমিকাদের আচরণ নিয়ে অযাচিত ও অসম্মানসূচক মন্তব্য করতো। আমার যা পছন্দ ছিলো না। আমি এর প্রতিবাদ করলে তিনি আমার গায়ে হাত তুলতো। আমার গায়ের রং, বডি শেইমিং করতো। এজন্য আমি সম্পর্ক থেকে সরে আসি।

তবে মারধরের বিষয়ে হিমাদ্রী মুখ খুলতে রাজি হয়নি। অভিযোগের বিষয়ে চন্দন সমাদ্দার সোম হিমাদ্রী বলেন, আমরা প্রায় দেড় বছর একটা সম্পর্কে ছিলাম। এই সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে প্রায় এক বছর আগে। এতদিন পরে এসে এইধরনের অভিযোগে আমি বিব্রত এবং বিরক্ত। এতদিন পরে এসে এধরণের কথা আমার জন্য মানহানিকর এবং আমিও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং আমার মনে হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মিথ্যামিশ্রিত। তারপরেও যেহেতু এধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে, আমিও চাই এই অভিযোগ যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তদন্ত হোক। আমারো অনেক কিছুই বলার আছে, আমি এইসকল তথ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করতে চাই। এই বিষয়ের যথাযথ তদন্তের আগেই এধরনের কথা সবখানে ছড়ায় বেড়ানোর ফলে আমার যে মানহানী হচ্ছে, আমি তারও বিচার চাইবো।


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ