ভূমধ্যসাগরে হারানো মানুষের পরিচয় কেনো অজানা থেকে যায়

ভূমধ্যসাগর
আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ রাফি  © সংগৃহীত

ভূমধ্যসাগর তীরে এপ্রিল আসে বাতাসে ফুলের গন্ধ আর তীরবর্তী শহরগুলীকে প্রানচাঞ্চল্যে ভরিয়ে দিয়ে। মেরোন এস্তেফানোস – যিনি অভিবাসীপূর্ণ নৌকা গুলোকে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেন, বসন্তের এই মোলায়েম সৌন্দর্য তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীদের জন্য হাজির হয় একগুচ্ছ ভয়ের বার্তা হিসেবে ।

“এ বছর কতো লোকের মৃত্যু দেখতে হবে আমাদের?” উগান্ডাতে কাজ করা ইরিত্রিয় অধিকারকর্মী এস্তেফানোস প্রায়ই নিজেকে এই প্রশ্ন করেন। “আরও কতো মা আমাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইবেন তাদের হারানো সন্তানদের খোঁজ?”

গত একদশকে উত্তর আফ্রিকা, তুরস্ক এবং ইউরোপের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই বিশাল জলরাশি গনমৃত্যুর এক মহামঞ্চে পরিণত হয়েছে। বিশ লক্ষাধিক মানুষ এই সময়ের মধ্যে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে, যার প্রায় আটাশ হাজারেরও বেশি এখনো নিখোঁজ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টারতদের অধিকাংশই সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসী। 

অভিবাসন নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের তথ্যানুসারে, ২০১৭ সালের পর এবছরের প্রথম প্রান্তিকে ভূমধ্যসাগরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। সংস্থাটির পরিচালক এন্টোনিয়ো ভিতোরিনো আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে এসব মৃত্যুকে অনেকটা ‘স্বাভাবিকীকরণ’ করা হচ্ছে। 

রেড ক্রস-এর অনুমান অনুযায়ী, এতো মৃত্যুর মধ্য থেকে মাত্র ১৩ ভাগের মৃতদেহ ইউরোপিয় কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করতে পারে, আর বিশাল সংখ্যক মানুষকে কখনোই চিহ্নিত করা যায় না। অভিবাসন নিয়ে কাজ করা আরেক কর্মকর্তার মতে, এই সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের আত্মীয়স্বজনের পক্ষে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়াটাও একরকম ‘লটারি জিতার মতোই’।

মিলান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক প্যাথলোজি বিষয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টিনা ক্যাটানেও, যার নেতৃত্বে ইটালিয় কর্তৃপক্ষের উদ্ধার করা মৃতদেহ শনাক্তকরণের কাজ চলমান, তিনি বলেন, “এই কাজ অবশ্যই যেকোনো বিমান দুর্ঘটনা থেকে কঠিনতর, কিন্তু স্বদিচ্ছা থাকলে তা (মৃতদেহ শনাক্তকরণ) অবশ্যই সম্ভব।“

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ক্রিস্টিনা ক্যাটানেও’র গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (যা ল্যাবানোফ নামে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত) কোনোপ্রকার সহায়তা দেওয়া হয় না। ইউরোপের সরকার গুলো সমুদ্রতটে ভেসে আসা মৃতদেহগুলোকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে কিছু সহায়তা করলেও এর সংরক্ষণ এবং শনাক্তকরণের কাজে কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। 

স্পেন সরকারের একটি কেন্দ্রীয় ফরেনসিক ডাটাবেইজ আছে যা শুধুমাত্র নিখোঁজ ব্যক্তির নাম দিয়ে অনুসন্ধানযোগ্য। নিখোঁজ অভিবাসিদের ব্যাপারে কাজ করার জন্য গ্রীস এবং ইতালি সরকারের বিভিন্ন অফিস এবং কর্তৃপক্ষের মধ্যকার সমন্বয় অতি সামান্য। ২০১৮ সালে ইতালি, মাল্টা, গ্রীস, এবং সাইপ্রাসের মধ্যে একটি আন্তঃদেশীয় চুক্তি সম্পন্ন হয় যার উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের মধ্যকার ফরেনসিক তথ্য নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পারসন্স’–এর সাথে ভাগ করা, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। 

এই নিদারুণ বাস্তবতার মধ্যে ক্রিস্টিনা ক্যাটানেও’র মতো মানুষরাই নিখোঁজ ব্যক্তিদের ঠিকুজি খোঁজার কাজ করছেন। ক্রিস্টিনা বলেন, “আপনাকে টিস্যুর নমুনা এবং প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সংগ্রহ করে ডাটাবেইজে সংরক্ষণ করতে হবে। (নিখোঁজ ব্যক্তির) আত্মীয়স্বজনের খোঁজ বের করাটা এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে কঠিনতম কাজ, কিন্তু তা অসম্ভব কিছু নয়” 

শেষ আশ্রয়স্থল
নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে থাকা স্বজনদের কাছে এস্তেফানোস সবচেয়ে পরিচিত মুখ এবং এই হতাশাক্রান্ত মানুষগুলোর সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। তারা এস্তেফানোসকে তাদের জানা সব ধরণের তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করে, যেমন; নিখোঁজ ব্যক্তি বহনকারী নৌকাটি কখন ছেড়ে যায়, কোন কোন পাচারকারীকে অর্থ দেওয়া হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের দেহ শনাক্তকরণের জন্যও বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়, যেমন;’সে (নিখোঁজ ব্যক্তিটি) ছেলেবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে দাঁত ভেঙ্গে ফেলে’।

এস্তেফানোস তাঁর নিজের ফেইসবুক এবং সাপ্তাহিক রেডিও-শোতে এই হতভাগ্যদের গল্প প্রচার করেন। তিনি এই নিখোঁজ মানুষদের খোঁজে হাঁসপাতাল এবং কারাগারে গিয়েছেন কিন্তু প্রতিবারই এস্তেফানোসকে হতাশ হতে হয়েছে। কখনও কখনও, জাহাজডুবি থেকে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তিদের থেকেও তথ্য পাওয়া যায় আবার অনেক সময় পাচারকারীরা তাদের জাহাজে থাকা যাত্রীদের তালিকা পাঠায়। 

বেশিরভাগ সময়ই অভিবাসী বোঝাই নৌকাগুলো এতটাই গভীরে ডুবে যায় যে নৌকাগুলোর আর খোঁজ পাওয়া যায় না। কখনোবা নিখোঁজ ব্যক্তিদের দেহাবশেষ ভিন্ন ভিন্ন উপকূলে পাওয়া যায়, কিন্তু শনাক্তকরণ তথ্যের অভাবে কর্তৃপক্ষ একপ্রকার নামকাওয়াস্তে তদন্ত করেই তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। এই মৃত দেহগুলোর যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিতকরণ এবং তাদের খুঁজতে থাকা স্বজনদের কথা চিন্তা করে হলেও আরও অনেক কিছু করার আছে বলে মনে করেন অভিবাসী বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মীরা । 

এস্তেফানোস বলেন ২০০৫ সালে নিখোঁজ হওয়া এক ব্যক্তির মা গত ১৮ বছর ধরে তাঁকে নিয়মিত ফোন করছেন। এস্তেফানোস তাঁকে বলেন, “আমি চাই আপনাকে একটি উত্তর দিতে কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়”, প্রতুত্যরে সেই মহিলা প্রশ্ন করেন, “তাহলে আপনি কেন এইটা বলছেন না যে সে মারা গিয়েছে?”

ইউরোপিয় ইউনিয়ন অভিবাসী ঠেকাতে বর্তমানে তৎপর রয়েছে, তারা মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন সরকারের সাথে একত্রে কাজ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে, এরমধ্যে – অভিবাসী বোঝাই নৌকাগুলোকে ইউরোপের জলসীমায় প্রবেশের আগেই আটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত, এবং এই যাত্রীদের জন্য বিভিন্ন ডিটেনসন সেন্টার তৈরিতে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ। 

মোটাদাগে বলতে গেলে ইউরোপের সরকারগুলো ঠিক তখনই তৎপর হয়ে ওঠে যখন ভয়ঙ্কর কোনো জাহাজডুবি গণমাধ্যমের নজরে আসে। এ বছরের ১৪ জুন যখন গ্রীসের জলসীমায় ৭৫০ জন যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার ডুবি হয় তখন দেশটি একটি বিরল পদক্ষেপ নেয়, তারা দুর্যোগের শিকার মানুষদের উদ্ধারে শনাক্তকরণ ব্যবস্থা চালু করে (যা ডিজাস্টার ভিক্টিম আইডেন্টিফিকেসন সিস্টেম নামে পরিচিত), যা সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নেওয়া হয়। গ্রীস সরকার এই দুর্দশাক্রান্ত অভিবাসীদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে মৃতদেহের পরিচয় নিশ্চিত করার চেষ্টা করে এবং তাদের স্বজনদের নিয়মিত তথ্য প্রদানের জন্য একটি হটলাইন চালু করে। 

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর গ্রীস এবং অন্যান্য জায়গাতে এমন আরও ডজনের বেশি জাহাজডুবির ঘটনা ঘটলেও তাতে কর্তৃপক্ষগুলোর কোনো হেলদোল দেখা যায়নি। নিখোঁজ অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘দ্য মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট’ এই সময়ের মধ্যে ভূমধ্যসাগরে প্রায় পাঁচশোর মতো মৃত্যু রেকর্ড করেছে।   

অধ্যাপক ক্রিস্টিনা ক্যাটানেও বলেন, “মানুষজন স্বেচ্ছায় এবং অত্যন্ত সচেতনভাবে এই সমস্যা থেকে তাদের মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে”।  

(লেখকঃ লুসিয়া লাভ্লাক, ক্লেয়ার পার্কার)
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
অনুবাদক: আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ রাফি


মন্তব্য